আজ ১০ই জানুয়ারী। পাকিস্তানের বন্দীত্ব থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস আজ। ১৯৭২ সালের ৭ই জানুয়ারী তিনি পাকিস্তানের বন্দীত্ব থেকে পরিত্রাণ পেয়ে ৮ই জানুয়ারী লণ্ডনে পৌঁছান এবং সেখান থেকে দিল্লি হয়ে ১০ই জানুয়ারী ঢাকায় অবতরণ করেন। ১৯৭২ সালে এ-দিনটি ছিলো সমগ্র জাতির কাছে পরম প্রত্যাশিত একটি দিন। এ-উপলক্ষে আমি নীচে আমার ১০-বিন্দু উপস্থাপন করছি।
১
দীর্ঘ বঞ্চনার বিরুদ্ধে সংগ্রামের পথে স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে ঐক্যবদ্ধ অথচ শান্তিপ্রিয় বাঙালী জাতির পূর্বখণ্ডের ওপর পাকিস্তানী হানাদারাবাহিনী ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ দিবাগত রাতে গণহত্যা ও ধর্ষণ শুরু করলে, বীরত্বে উত্থিত হয়ে এ-জাতির ছাত্র-সৈনিক-শ্রমিক-কৃষক-সহ পূর্ণ আত্মবিশ্বাস সহকারে স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরু করে বহু ত্যাগ-তিতিক্ষা ও লক্ষ-লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে শত্রুসেনাদের পরাজিত করে বিজয়ীর বেশে বিশ্বের মানচিত্রে একটি মর্য্যাবান ও সম্ভাবনাময় জাতি হিসেবে আবির্ভুত হয়। এটি বিশ্বের ইতিহাসে এমন একটি ঘটনা, যার প্রকৃত তাৎপর্য্য এখনও বাঙালী জাতির রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীরা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়নি তাঁদের কাছে সে-বুদ্ধিবৃত্তিক তাত্ত্বিক হাতিয়ার নেই বলে।
২
১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ থেকে ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত পরিচালিত ৯ মাসের স্বাধীনতাযুদ্ধ ছিলো সমগ্র জাতি ও দেশের জন্য অভিজ্ঞতায় ও মানসিকতায় অভূতপূর্ব। এ-যুদ্ধ এ-জাতিকে যে-অভূতপূর্ব গতির মধ্যে স্থাপিত করে, যে-কোনো কারণেই হোক না কেনো, যুদ্ধে অনুপস্থিত থাকা শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে এ-গতি উপলব্ধি করা সম্ভব ছিলো না। রূপতঃ গর্ভবতী মা ছাড়া যেমন প্রসববেদনা ও জন্মদানের অভিজ্ঞতা অন্য কারও পক্ষে বুঝা সম্ভব নয়, তেমনিভাবে যুদ্ধে অনুপস্থিত থাকা শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে যুদ্ধের ভয়াবহতা ও আক্রান্ত জাতির অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। কারণ, বাংলা ও বাঙালী জাতি ২৫শে মার্চে যা ছিলো, ১৬ই ডিসেম্বরে তা একটি রক্তাক্ত বিপ্লবের মাধ্যমে মৌলিকভাবে পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিলো।
৩
শেখ মুজিবুর রহমান বাংলা ও বাঙালী জাতির সেই পরিবর্তনের প্রকৃতি বুঝতে পারেননি। আর, বুঝতে না পারার কারণে তিনি ভুল পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। কিন্তু, ব্যক্তি নির্বিশেষ প্রতি ক্রিয়ারই একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে। ফলে, স্বাধীনতাপূর্ব বাংলা ও বাঙালী জাতির জন্যে যে শেখ মুজিবুর রহমান নজির বিহীন নন্দিত নেতা, স্বাধীনতার পর তিনি হয়ে গেলেন নজিরবিহীন নিন্দিত শাসক। যে-শেখ মুজিবুর রহমান বাংলায় ও বাঙালী জাতির গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্যে দীর্ঘ কারাবাস করেছেন, পারিবারিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যকে তুচ্ছ জ্ঞান করে দেশ-জুড়ে মানুষের কাছে গিয়ে মানুষের অধিকারের কথা বলেছেন, তিনিই এই জাতির গণতান্ত্রিক অধিকার অস্বীকার করে একদলীয় স্বৈরশাসন বাকশাল-ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন।
৪
আমার এ-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফিরে এসে জাতির মধ্যে রিকনসিলিয়েইশন বা পুনর্সংহতি চেয়েছিলেন, কিন্তু তিনি যুদ্ধবিজয়ী তারুণ্যের বিরোধিতার মুখে পড়ে ক্ষিপ্ত হয়ে তাদেরকে শায়েস্তা করার নীতি গ্রহণ করেন। আমি মনে করি, এটি ছিলো তাঁর ভুল। তাঁর উচিত ছিলো সমগ্র মুক্তিবাহিনীকে সেনাবাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করা। যে-মুক্তিবাহিনী দেশ স্বাধীন করেছে, দেশ রক্ষার ক্ষেত্রে তাঁদের চেয়ে যোগ্যতর আর কেউ হতে পারে না। তাঁর আরও উচিত ছিলো, দেশে ফেরার সাথে-সাথে আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব তাজউদ্দিনের হাতে ন্যস্ত করা এবং একটি সর্বদলীয় জাতীয় পুনর্গঠন সরকার গঠন করে ‘মৌর্যাল অথোরিটি’ হিসেবে গান্ধীর মতো ‘পিতা’ হয়ে থাকা।
৫
এ-ব্যাপারেও কোন সন্দেহ নেই যে, শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালী জাতির পূর্বখণ্ডের অবিসংবাদিত নেতা রূপে বিকশিত হয়েছিলেন। এ-নেতৃত্ব একদিনে গড়ে ওঠে না। এমন গণনন্দিত ও সর্বগ্রাহ্য নেতা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে নেতার ও জাতির অনেক সংগ্রাম করতে হয়। তাই, এ-নেতৃত্বের ভুল পদক্ষেপে জাতি যে ঐতিহাসিক ভোগান্তির মধ্যে পড়ে, তা হয় অসামান্য ও সুদূর প্রসারী। শেখ মুজিবুর রহমানের একদলীয় ও একনায়কী শাসন ছিলো এমন এক সুদূর প্রসারী ভুল, যার রেশ আজও বিদ্যমান। তিনি ফিরে এসে যা করতে পারতেন, আজ তা করতে গেলে হয় ১৯৭০ সালের নির্বাচনের মতো একটি জাতীয় ঐক্যমত অথবা ১৯৭১ সালের যুদ্ধের মতো আরেকটি বিপ্লবের প্রয়োজন হবে।
৬
শেখ মুজিবুর রহমানের প্রথমেই উচিত ছিলো বাঙালী জাতীয় আত্মপরিচয়ের বিষয়টি শুধু সাংবিধানিকভাবে নয়, শিক্ষা ও সংস্কৃতির মধ্যে নিশ্চিত করা। এর জন্যে তাঁর উচিত ছিলো সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থাকে ভেঙ্গে নতুন করে গড়া। প্রথাগত সাধারণ বিদ্যালয়, কওমি মাদ্রাসা, আলিয়া মাদ্রাসা, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল ইত্যদি বিভিন্ন প্রকারের কারিকুলাম পালটে সমগ্র জাতির সকল শিশুকে একটি অভিন্ন ন্যাশনাল কারিকুলামের অধীনে নিয়ে এসে শিক্ষিত করে তোলার কাজটি ১৯৭২ সালের ১১ই জানুয়ারীতে থেকে শুরু করা। তখন তিনি যা বলতেন, তাই পালিত হতো। আর, সেটি হলে আজ আমরা সাধারণ, ইসলামিক, বিদেশী, এ-তিন প্রকার কারিকুলামে শিক্ষাপ্রাপ্ত তিন প্রকারের বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গি ও জাতির প্রতি মনোভঙ্গি সম্পন্ন তিন প্রকারের আত্মপরিচয়ের বাঙালী পেতাম না।
৭
শেখ মুজিবুর রহমান একদলীয় বাকশালী শাসনের বিরুদ্ধে প্রয়োজন ছিলো একটি গণ-অভ্যূত্থানের বা একটি গণ-বিপ্লবের। কিন্তু বিপ্লবী শক্তিসমূহের হটকারিতার জন্যে বিপ্লবের সম্ভাবনা রুদ্ধ হয় এবং অপ্রত্যাশিত সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে। আর, এ-সামরিক অভ্যূত্থান ছিলো ব্যক্তিগত হিংসাজাত এক অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র। এ-অভ্যূত্থানের হোতারা জাতির শীর্ষ-নেতাকেই শুধু হত্যা করেনি, তাঁর পরিবার ও বর্ধিত পরিবারের নারী ও শিশুদেরকেও হত্যা করে যে-অপরাধ করে সমগ্র জাতির প্রতি অপরাধ করেছে। এদের এ-হত্যাপরাধের মাত্রাগত তীব্রতা বিশ্বের ইতিহাসে নজিরবিহীন। এটি রূপতঃ গ্রীক পৌরাণিক কাহিনীর মতো এমন একটি ‘পাপ’, যার প্রায়শ্চিত্ত এখনও বাঙালী জাতি করেই যাচ্ছে।
৮
শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর অসামান্য কর্মের কৃতিত্ব এবং ভুলের সমালোচনা করেই বাঙালী জাতির পূর্বখণ্ডের ইতিহাসে সবার উপরে স্থান দিতে হবে। পৃথিবীর কোনো মানুষই নির্গুণ আর নির্দোষ নয়। এটি একটি সর্বজনীন সত্য। কিন্তু এ-সত্যকে অস্বীকার করে যদি কেউ তাঁকে যদি বাইনারি পদ্ধতি ডিজিটাইজ করে “হয় দেবতা, নয়তো শয়তান” বানানোর চেষ্টা করা হয়, তা বাস্তবতা সম্মত ও ন্যায়সঙ্গত হবে না। আর, যা বাস্তবতা সম্মত ও ন্যায়সঙ্গত নয়, তা মানুষের ওপর বল প্রয়োগের মাধ্যমে সায়মিকভাবে আরোপ করা গেলেও শেষ পর্যন্ত পারা যায় না। বাঙালী রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীগণ আজ Camp’47 বনাম Camp’71-এ মেরুকৃত হয়ে যাওয়ার কারণ, তাঁরা বস্তুনিষ্ঠত ও নৈর্ব্যক্তিক সত্য বলতে পারছেন না।
৯
শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর যোগ্যস্থানে স্থাপন করার পর, আওয়ামীলীগ-সহ কোনো দলের পক্ষেই উচিত নয়, তাদের দৈনন্দিন রাজনৈতিক প্রচারে ও প্রতিযোগিতায় তাঁকে রেফার করা বা ‘ব্যবহার’ করা। তাঁকে সকল চলমান বিতর্কের ঊর্ধ্বে স্থাপন করে রাজনীতির নতুন অধ্যায় শুরু করা প্রয়োজন। একইভাবে, বাঙালী জাতির স্বাধীনতা যুদ্ধে যে জাতীয় নেতৃত্ব, তরুণ নেতৃত্ব ও সামরিক নেতৃত্ব অসামান্য ভূমিকা রেখেছেন, তাঁদের সেই ভূমিকা কৃতিত্ব দিয়ে এবং তাঁদেরও পরবর্তী শুভ ও অশুভ কর্মের যথাযথঃ মূল্যায়ন করে যথাস্থানে স্থাপন করতে হবে একইভাবে দৈনন্দিন রাজনীতিতে তাঁদের ‘ব্যবহার’ বন্ধ করতে হবে।
১০
বাঙালী জাতি যতোদিন না পর্যন্ত ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাস ও ব্যক্তিত্ব নিয়ে ঐক্যমতে পৌঁছুতে সক্ষম হবে, ততোদিন পর্যন্ত এ-জাতির মধ্যে আত্মঘাতী আত্মকলহ বন্ধ হবে না। আর, ঐক্যমতের ভিত্তি হবে প্রথমতঃ অবিভাজ্য বাঙালী আত্মপরিচিতি, দ্বিতীয়তঃ ইতিহাসের বস্তুনিষ্ঠতা ও ধারণক্ষমতা, তৃতীয়তঃ সাম্য-মর্য্যাদা-ন্যায়বিচারের বিধি এবং চতুর্থতঃ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ভাষাজনজাতি হিসেবে যোগ্য বিশ্বভূমিকা। আমি মনে করি, এ-বাঙালী জাতি এ-চার চক্রে স্থাপিত হলে বিশ্বের বিস্ময় হয়ে বিকশিত হবে।
রোববার ১০ জানুয়ারী ২০১৬
লণ্ডন, ইংল্যাণ্ড
ফেজবুক পাতা থেকেঃ https://www.facebook.com/profile.php?id=100001574856134&mibextid=ZbWKwL