মঙ্গলবার, ২৩শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১০ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

করোনা ভাইরাস,বিশ্বাসী ও সৎকর্মশীল

 

 

 

জাকির মজুমদার 


মানুষ মরণশীল। মৃত্যুর স্বাদ তাকে গ্রহণ করতেই হবে। তাই মৃত্যু নিয়ে আমি নির্ভার। কারণ জন্মেছি বলে মৃত্যু অনিবার্য। আর যতক্ষণ বেঁচে আছি তা-ই মূলত অস্বাভাবিক। তাই মৃত্যু যেভাবেই হোক, তা নিয়ে আমার ডর-ভয় নেই। কিন্তু আমার ভয় পরকালীন জবাবদিহিতা নিয়ে, মহান আল্লাহ সোবাহানাহু তাআলার সামনে দাঁড়ানো নিয়ে। পুনরুত্থান দিবসে আল্লাহ হিসাব চাইলে কোনো মানুষেরই সাধ্য নেই যে, দুনিয়ায় আল্লাহর নেয়ামত ভোগের বা নিজ কর্তব্য ও দায়িত্ব পালনের হিসাব দেয়ার যোগ্যতা বা সামর্থ রাখে। তাই তাঁর দয়ার ওপরই আমি নির্ভর করি।

আজ করোনা ভাইরাস নামক যে বৈশ্বিক মহামারি আমাদের জীবনকে সংকুচিত করে ফেলেছে। তাকে কি কেবল সংক্রমণ ব্যাধি হিসেবেই আমরা চিহ্নিত করবো? ক্রমাগত ব্যক্তি সমাজ রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অন্যায় অবিচার জুলুম পাপ পঙ্কিলতার যেই স্রোতধারা তৈরি হয়েছে সেটি কী তারই প্রতিক্রিয়া নয়?

করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে আজ বিশ্ব যেভাবে ভ্যাকসিন বা ওষুধ আবিষ্কারে উঠে-পড়ে লেগেছে, সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছে- হয়তো একদিন এই ভাইরাস প্রতিরোধক আবিষ্কারও হবে। কারণ মহান আল্লাহ সোবাহানাহু তাআলার ঘোষণা- ‘আমি এমন কোনো রোগ তোমাদের ওপর আবর্তিত করি না, যার প্রতিষেধক বরং আগেই দিয়ে থাকি।

কথা হলো, করোনা প্রতিরোধক প্রক্রিয়া আবিস্কারের মতই বিশ্ব, রাষ্ট্র, সমাজ ও ব্যক্তিকে তাদের জীবনাচরণ সংশোধনেও আত্মনিয়োগ করা জরুরি। প্রথমতো মানুষের মধ্যে নৈতিকতার তাগিদ সৃষ্টি সবার আগে ফিরে আসা প্রয়োজন। বিশ্বে করোনা দুর্যোগের ছয়মাস অতিক্রান্ত হতে চললেও মানুষের অভ্যাস, আত্মকেন্দ্রিকতা ও মনুষ্যত্বে বিন্দু পরিমাণ আচরণ পরিবর্তন হয়েছে এমনটিও আঁচ করা যায় না। বরং এই দুর্যোগেও ব্যক্তির আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার চেষ্টা, অনিয়ম, অমানবিকতা ও চরম আত্মকেন্দ্রীকতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আর সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে মিথ্যাচার, প্রতারণা, অন্যায়-জুলুম ও বর্ণবাদকে উসকে মানুষের জীবনকে দুঃসহ করে তোলার প্রক্রিয়াও আমরা দেখছি। অন্যদিকে বৈশ্বিক যুদ্ধ, বিগ্রহ, আধিপত্যবাদ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিস্তৃতি ঘটছে এখনো। এসবের লাগাম টেনে ধরতে না পারলে হয়তো অদূর ভবিষ্যতে করোনা ভাইরাসের চেয়েও মারাত্মক কোনো খোদায়ি আজাবের জন্য মানুষকে এবং এ বিশ্বকে প্রস্তুত থাকতে হবে।

আমি ব্যক্তিগতভাবে আল্লাহ নির্ভরশীল একজন মানুষ। আমার ব্যক্তি জীবনের দৈনন্দিন জীবনাচরণ, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য মহান আল্লাহ সোবাহানাহু তাআলার সন্তুষ্টিকে ঘিরেই আবর্তিত হয়- এ বিষয়ে আমি সচেতন থাকার চেষ্টা করি। তারপরও মানুষ হিসেবে ভুলের ঊর্ধ্বে নয় বলে তাঁর অসন্তুষ্টি থেকে পানাহ চাই।

পৃথিবীতে অনেক মতবাদ ক্রিয়াশীল, ওইসব মতবাদের ধারক-বাহকরা পার্থিব জীবনে মানুষের জন্য কল্যাণ কামনা করে বা বৈষয়িক দিক দিয়ে কিছু কিছু ক্ষেত্রে কল্যাণধর্মীও বটে। সেই মতবাদ প্রতিষ্ঠায় সমাজে বা দেশে দেশে অনেক মুসলমান (আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণকারী) নামধারী ভাইদেরও চেষ্টার অন্ত নেই। কিন্তু সেই মতবাদ বা চেষ্টা শুধু দুনিয়ার জন্যেই সার, আখেরাতে সেই চেষ্টা-সাধনার ফল ভাগ্যে জুটবে না। আল্লা সোবানাহু তাআলা বলেছেন, যারা পার্থিব জীবন চাইবে আল্লাহ তাদের কিঞ্চিত দুনিয়াদারী দিবেন কিন্তু আখেরাতে তারা কিছুই পাবে না।

আমি ব্যক্তিগত ভাবে আখেরাতকে প্রাধান্য দিয়ে মানুষের পার্থিব জীবনের সফলতা ও কল্যাণ প্রত্যাশার পাশাপাশি পরকালীণ মুক্তির বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকি। কারণ মানুষের আসল ঠিকানা আখেরাত। তাই আল্লাহ সোবাহানাহু তাআলা কোরআনে বার বার ‘বিশ্বাসী ও সৎকর্মশীলদের’ জন্য জান্নাতের ওয়াদা করেছেন। এখানে উল্লেখ্য যে, আমার যদি ভুল না হয়ে থাকে- শুধু এককভাবে বিশ্বাসী বা এককভাবে সৎকর্মশীলদের উদ্দেশ্য করে আল্লাহ জান্নাত দেয়ার ওয়াদা করেননি। কোরআনের যেখানেই আমি আল্লাহকে জান্নাতের ওয়াদা করতে দেখেছি সেখানেই আল্লাহ ‘বিশ্বাসী ও সৎকর্মশীলদের’ জান্নাতে দাখিলের কথা বলেছেন। এর মানে, বিশ্বাসী কিন্তু সৎকর্মশীল নন, আবার সৎকর্মশীল কিন্তু বিশ্বাসী নন- তাদের জন্য আল্লাহ জান্নাতের ওয়াদা করেননি।

যেমন দুনিয়ায় এমন অনেককে দেখেছি ব্যক্তিগতভাবে তিনি সৎ বা পার্থিব জীবনে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সোচ্চার, কিন্তু আল্লাহর হুকুম ও বিধান পরিপূর্ণভাবে মানুষের জীবনে ও সমাজে প্রতিষ্ঠিত হোক তা বিশ্বাস করেন না অথবা মানতে চান না। তাহলে কি দাঁড়ালো? ওই ব্যক্তি বা গোষ্ঠির উদ্দেশ্য সৎ বা পার্থিব জীবনের জন্য কল্যাণকর হলেও তিনি বিশ্বাসী নন। আবার একই ভাবে কোনো ব্যক্তি বা এমন অনেকেই আছেন যারা আল্লাহ, নবী, নামাজ-রোজা, হজ্জ-যাকাত, আখেরাত-বিচার দিবসকে বিশ্বাস করেন। কিন্তু তিনিও আল্লাহর বিধানকে পরিপূর্ণভাবে সমাজে প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে গাফলতি করেন অথবা বাধা প্রদান করেন এমনকি অনৈতিক কর্মকান্ড ও অন্যায়-অপরাধ করে বেড়ান, সৎকর্মের বিষয়ে উদাসীন থাকেন, তারা কিন্তু কোনো অবস্থাতেই সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্তি হতে পারেন না।

আবার আজ ইসলাম, আল্লাহ ও নবী সা. এর নামে বিশ্বে বিশৃঙ্খলা ও মানুষ হত্যা করতে দেখা যায়। আল্লাহ সোবাহানাহু তাআলা বলেছেন, বিনা অপরাধে একজন মানুষকে হত্যা গোটা মানবজাতিকে হত্যা করার শামীল। আর একজন মানুষের জীবন রক্ষা করা গোটা মানবজাতিকে রক্ষা করার সমতুল্য। ইসলামের নামে বিজাতীয়দের মদদে স্বয়ং ইসলামের সুমহান শান্তির আবহকে বিকৃতরূপে বিশ্ব সমাজে তুলে ধরতে মুসলমান নামধারী বিপথগামীরা দেশে দেশে বিশৃঙ্খলা ও মানুষ হত্যা করতে দেখা যায়। অথচ আল্লাহ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের বিষয়েও চরম কঠোর।

আর তাই আল্লাহ পরকালে কেবল তাদের বিষয়েই দয়া দেখানোর কথা বলেছেন, যারা একই সঙ্গে বিশ্বাসী ও সৎকর্মশীল এর মানে যারা আল্লাহকে বিশ্বাস করে তার হুকুম ও বিধান মতো ব্যক্তিজীবন গঠনের পাশাপাশি সমাজ জীবনেও তার বাস্তবায়নে নৈতিক, আত্মিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতির চেষ্টা করেন। একই সঙ্গে মানবতা ও প্রতিবেশির কল্যাণে ক্রিয়াশীল জীবন অতিবাহিত করেন তারাই মূলত বিশ্বাসী ও সৎকর্মশীল।

মহান আল্লাহ সোবাহানাহু তাআলার কাছে বিনীত প্রার্থনা, তিনি আমাদের সঠিক বুঝ দান করুন। সর্বাবস্থায় তাঁর দাসত্বকে মেনে নেয়ার পাশাপাশি দেশ জাতি ও মানবতার প্রতি কল্যাণ করার তৌফিক দান করুন- আমিন


জাকির মজুমদার 

সাংবাদিক, কলামিস্ট ও সমাজকর্মী

Comments are closed.

More News Of This Category