১.পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি। যা ‘শান্তি'(?) চুক্তি নামে সমধিক পরিচিত। ‘শান্তি’ শব্দটি চুক্তির কোনো ধারায় উল্লেখ না থাকলেও সরকার পক্ষের প্রচারণায় সাধারণ মানুষের মনে তা স্থান পেয়েছে বেশি। এ চুক্তি পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মুক্তির সনদ না হলেও এটি নিঃসন্দেহে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের একটি চলমান প্রক্রিয়া।
তাই বলা যায়, ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সম্পাদিত ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি’ নিঃসন্দেহে একটা পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বায়ত্ত শাসনের দলিল। যা চুক্তি স্বাক্ষরের ২০দিন পর অর্থাত্ ২২ ডিসেম্বরে মন্ত্রী পরিষদে পাশ হয় এবং গেজেট প্রজ্ঞাপন জারী করা হয়। এ চুক্তি বাস্তবায়ন হলে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল একটি স্বায়ত্ত শাসিত অঞ্চলের মর্যাদা পাবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। যা চুক্তির প্রস্তাবনায় স্পষ্ট বলা হয়েছে,- “বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের আওতায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতার প্রতি পূর্ণ ও অবিচল আনুগত্য রাখিয়া পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে সকল নাগরিকের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা ও অর্থনৈতিক অধিকার সমুন্নত এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা এবং বাংলাদেশের সকল নাগরিকের স্ব স্ব অধিকার সংরক্ষণ ও উন্নয়নের লক্ষ্যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তরফ হইতে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক জাতীয় কমিটি এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার অধিবাসীদের পক্ষ হইতে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি নিম্নে বর্ণিত চারি খণ্ড(ক, খ, গ, ঘ) সম্বলিত চুক্তিতে উপনীত হইলেন।
২.
বস্তুত এই ধারায় বোঝানো হয়েছে, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের সকল নাগরিক’ বলতে চুক্তির ‘খ’ খণ্ডের ৪নং ধারার ৫ উপ-ধারা আইনের ধারা মোতাবেক পার্বত্য চট্টগ্রামের যারা নাগরিক বা বাসিন্দা হিসেবে বিবেচিত হবেন তাদের কথা বলা হয়েছে।
চুক্তির ‘ক’ খণ্ডের ‘সাধারণ’-এ পার্বত্য চট্টগ্রামকে একটি উপজাতীয়(আদিবাসী) অধ্যূষিত অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতি ও এর বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণের বিধান করা হয়েছে। যদিও উল্লেখিত বৈশিষ্ট্য পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে এখনো দৃশ্যমান হয়নি। এই ধারা বাস্তবায়ন করা হলে আদিবাসীদের বেদখলকৃত জায়গা-জমি ফেরত পাবে এবং বহিরাগত বাঙালিদের অন্যত্র(দেশের সমতল অঞ্চল থেকে আগত) পুনর্বাসন দিয়ে পাঠানো হবে। আর তখনই পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি স্বায়ত্ত শাসিত অঞ্চলের রূপ পাবে তাতে কোনো আশংকা থাকবে না।
চুক্তির সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে হলে সরকারকে প্রথমে চুক্তির ‘খ’ খণ্ডের ৪নং ধারার ৫ উপ-ধারা মেনে পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনের ৯(নয়) নং ধারা অনুযায়ী কেবল পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে তিন পার্বত্য জেলার ভোটার তালিকা প্রণয়ন করার কথা বলা হয়েছে। আর প্রণীত তালিকার ভোটাররাই কেবল তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্বাচনসহ দেশের সকল জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে অংশগ্রহন করার অধিকার রাখবে। এই ধারা বাস্তবায়ন করতে হলে সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে পুনর্বাসিত বাঙালিদের এই এলাকার বাইরে সম্মানজনক ও যথোপযুক্তভাবে পুনর্বাসন দিতে হবে। এতে করে পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি স্বায়ত্ত শাসিত অঞ্চল মর্যাদা লাভের যাত্রাপথ সুগম হবে।
৩.
ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা:
চুক্তির ‘খ’ খণ্ডের ২৬ নং ধারা অনুযায়ী পার্বত্য জেলার এলাকাধীন বন্দোবস্তযোগ্য খাসজমিসহ কোন জায়গা-জমি পরিষদের পূর্বানুমোদন ব্যতিরেকে ইজারা প্রদানসহ বন্দোবস্ত, ক্রয়, বিক্রয় ও হস্তান্তর না করা এবং পার্বত্য জেলা পরিষদের নিয়ন্ত্রণ ও আওতাধীন কোন প্রকারের জমি, পাহাড় ও বনাঞ্চল পরিষদের সাথে আলোচনা ও ইহার সম্মতি ব্যতিরেকে সরকার কর্তৃক অধিগ্রহন ও হস্তান্তর না করার বিধান পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনে যথাযথ অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। যদিও এখনো তা যথাযথভাবে কার্যকর করা হচ্ছে না।
চুক্তির এই ধারা/সমূহ বাস্তবায়ন হলে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনার কার্যক্রম সম্পূর্ণ স্বায়ত্ত শাসনের মর্যাদা লাভ করবে।
একই খণ্ডের(খ) ২৪ নং ধারা মোতাবেক পার্বত্য জেলা পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর ও তদনিম্ন স্তরের সকল সদস্য প্রবিধান দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে পরিষদ কর্তৃক নিযুক্ত করা ও পরিষদ তাদের বদলী ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহন করার ক্ষমতা রাখে। এতে করে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনে সুষম মানসিকতা তৈরি হবে এবং এ অঞ্চলের অধিবাসীরা সুষম আইন লাভ করবে। যা বর্তমানে পাচ্ছে না। বিশেষ করে আদিবাসীরা পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে সাম্প্রদায়িক আচরণের শিকার হতে হয় প্রতিনিয়ত। চুক্তি পূর্ণ বাস্তবায়ন হলে এই অবস্থা আর থাকবে না।
৪.
উপরের আলোচিত বিষয়সমূহে স্পষ্ট বোঝা যায়, সরকার চুক্তি বাস্তবায়নের গতিকে সঠিক ধারাবাহিকতা বজায় না রাখায় পাহাড়ের মানুষ আজ চুক্তির প্রতি অনীহা প্রকাশ করতে শুরু করেছে।
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর স্বাক্ষরের পর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে সরকার এই অঞ্চলের ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তিকরণে হাত দেয়। চার খণ্ডের চুক্তির ‘ঘ’ খণ্ডের ৪নং ও ৫নং ধারা অনুযায়ী ১৯৯৯ সালের ৩ জুন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি জনাব আনোয়ারুল হক চৌধুরীকে কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগের মাধ্যমে যাত্রা শুরু হয়। কাজের কাজ কিছুই না হলেও কমিশনে চেয়ারম্যান নিয়োগ করা অব্যাহত রাখে সরকার। যা একেবারেই অযৌক্তিক ছিল।
চুক্তির ‘ঘ’ খণ্ডের ৪ ও ৫ নং ধারা বাস্তবায়নের আগে সবচেয়ে জরুরী বিষয় ছিল ‘খ’ খণ্ডের ৪নং ধারার ৫ উপ-ধারা বাস্তবায়ন করে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের স্থায়ী বাসিন্দা সনাক্ত করে ৯নং ধারা বাস্তবায়ন করা। কারণ, ‘ঘ’ খণ্ডের ৪নং ধারায় কেবল ভারত প্রত্যাগত উপজাতীয় শরনার্থীদের জমি-জমা বিষয়ক বিরোধ দ্রুত নিষ্পত্তি করার কথা বলা হয়েছে। এখানে, পূনর্বাসিত বাঙালিদের কথা কোথাও উল্লেখ করা হয়নি। এবং ‘খ’ খণ্ডের ৪ ও ৫ নং ধারা বাস্তবায়ন করার মাধ্যমে পুনর্বাসিত বাঙালিদের সম্মানজনকভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে পুনর্বাসন দেয়া হলে ‘ঘ’ খণ্ডের ২, ৩ ও ৪ নং ধারা বাস্তবায়নে কোনো অন্তরায় থাকবে না।
৫.
স্বায়ত্ত শাসন বলি আর পূর্ণ স্বায়ত্ত শাসন, আন্দোলন ব্যতীত লাভ করা সম্ভব নয়। পূর্ণ স্বায়ত্ত শাসনের কথাই যদি বলি তাহলে বলতে হবে, সম্পূর্ণ একটি আলাদা রাষ্ট্র। অনেকের ভাষ্যমতে, “জুম্ম ল্যান্ড”। এটি সম্পূর্ণ জুম্ম তথা আদিবাসীদের রাষ্ট্র হবে। একটা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হতে ভেঙ্গে আরেকটা আলাদা রাষ্ট্র গঠন করা চারটি খানি কথা নয়। তার জন্য কেবল ব্যানার ফেস্টুন হাতে নিয়ে রাজপথে শ্লোগান দিলে সরকার ভয়ে বা খুশি হয়ে দেবে না। এটা ভূললে চলবে না যে, যে কোনো অধিকার ‘শিশুর হাতের মোয়া’ নয়। চাইলেই পাওয়া যাবে। তার জন্য আদিবাসীদেরকে এই সরকারের বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে চূড়ান্ত গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ঘোষণা করতে হবে। আমি জানি না, সশস্ত্র যুদ্ধ ঘোষণা করার মত শক্তি-সামর্থ্য আমাদের আছে কি-না। স্বায়ত্ত শাসনের পরিবর্তে যদি সম্পূর্ণ একটা আলাদা রাষ্ট্র জুম্ম জাতি পায় তাহলে অসুবিধা কোথায়? কিন্তু এ অসম্ভব অধিকার আদায় করার মতো আমাদের সবার মানসিক প্রস্তুতি ও শক্তি-সামর্থ্য আছে কি?কোনো গতিশীল স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হতে পূর্ণ স্বায়ত্ত শাসনের অধিককার আদায় করতে হলে অগণতান্ত্রিকভাবে সশস্ত্র সংগ্রাম করতেই হবে।
কিন্তু আমরা কতটুকু প্রস্তুত? সংগ্রামী ছাত্র ও যুব বন্ধুদের কাছে আমার এ অপরিপক্ক প্রশ্ন।
মূলত সংগ্রামী নতুন মুখ ছাত্র বন্ধুদের উদ্দেশ্যে কিছু বলার জন্যই আমার এ অপঙতেয় লেখা। আমি নিশ্চিত বলতে পারি, পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমান প্রেক্ষাপটে তোমরা অনেকেই দোদূল্যমান ভাবনা নিয়ে নিজস্ব জীবনের লক্ষ্যের পথে হাটঁছ। হয়তো এই ভেবে তোমরা লক্ষ্য ঠিক করতে পারোনি যে, ‘কী হবে এসব আন্দোলন করে?’ কার বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম? ভাইয়ে ভাইয়ে লড়াই করে অকালে ঝরে পড়ার নাম কী আন্দোলন-সংগ্রাম? আমাদের অভিভাবকেরা দীর্ঘ পঁচিশ বছর নিরন্তর-নির্ঘুম সংগ্রাম করে যখন কিছুই পেলো না আমরাই বা কী আশা করতে পারি এ রাষ্ট্রের কাছে? এই জাতীয় ইত্যাদি ইত্যাদি প্রশ্নের উঁকি মারতে পারে মনে। সংগঠনের পতাকা তলে এসে আন্দোলনের নাম যা করছ তা নিছকই দায়ে পড়ে। কেউ এলাকায় অবস্থানের জন্য, কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য, কেউ বা সামান্য আর্থিক স্বচ্চলতা ভারসাম্য রাখার জন্য ব্যক্তিগত দায়ে পড়ে চলমান আন্দোলনের কর্মসূচিতে অংশগ্রহন করেছিলে। আমি নিশ্চিত বলতে পারি, স্বার্থ পূরণ হলেই কেটে পড়ার মানসিকতাও অনেকের প্রস্তুতি চলছে।
৬.
জীবন-মৃত্যু ও সংগ্রাম: জীবন তখনই পরিপূর্ণ লাভ করতে পারে যখন জীবনটা স্বকীয়তা লাভ করে। মানব হিসেবে সম্পূর্ণ অধিকার ভোগ করে পৃথিবীতে বেঁচে থাকার অধিকার প্রত্যেক মানুষের রয়েছে। আর এ অধিকার ইতিহাসের সর্ব সময়ে সংখ্যাগুরুরা নিয়ন্ত্রণ করার অপচেষ্টা করে এসেছিল। কিন্তু কোনো পরাশক্তি রাষ্ট্রও এ বলপূর্বক নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত রাখতে পারেনি। ব্রিটিশ শাসনের ইতিহাস নিশ্চয় জানা থাকবে। ব্রিটিশরাও পারেনি। কেনো পারেনি?তাদের এ নিয়ন্ত্রণ থেকে রেহায় পেতে মানুষ শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে আন্দোলন করেছিল জীবন বাজি রেখে। জীবনকে হাসিমুখে মৃত্যুর কোলে ঠেলে দিয়েছে। আমরা সবাই জানি, সূর্যসেন, প্রীতিলতা, ক্ষুদিরামদের জীবনের বিনিময়ে ভারতীয় উপমহাদেশ স্বাধীন হয়েছিল।
মৃত্যুর কথা ভেবে লাভ নেই। জন্ম নিলেই মৃত্যুও অনিবার্য। কত দূর্ঘটনা, সাপে কামড়, কুকুরের কামড়, কঠিন রোগে, অপুষ্টিতে ভোগে প্রতিদিন কত মানুষ মারা যাচ্ছে। তাঁর কোনো হিসেব আমাদের কাছে নেই। মানুষের মৃত্যু হবেই। কিন্তু মহান মানুষের মৃত্যু নেই। হতে পারে না।
৭.
আমরা যদি পার্বত্য চট্টগ্রামের অগ্নিকন্যা কল্পনা চাকমার কথা ভাবি, ভাবুনতো, এই মহান মানুষকে মেরে ফেলার ক্ষমতা কার আছে এখন? কল্পনা চাকমা মৃত্যুকে জয় করেছে। আজ ঈশ্বরেরও ক্ষমতা নেই যে কল্পনা চাকমাকে মেরে ফেলার। আমরা কখনো কল্পনার শেষকৃত্যানুষ্ঠান দেখতে পাবো না। আমরা কখনো তার ‘সাত দিইন্ন্যা’ অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ পাবো না। কারণ, তিনি অমরত্ব লাভ করেছেন। এই পৃথিবী প্রলয় হতে পারে, কিন্তু কল্পনা চাকমার প্রলয় কখনই হবে না।
‘দালাল’ বলে একটা প্রচলিত শব্দ আছে। এ শব্দটি বেশ কয়েকটা স্তরে বা ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে বললে দালাল মানে কেনাবেচার মধ্যস্থতাকারী। ক্রেতা ও বিক্রেতার মাঝখানে তাঁর পায়চারী। বিক্রেতার কাছ থেকে ৯০ টাকায় কিনে ক্রেতার কাছে ১০০ টাকা বা তার অধিক হিসেব দেখিয়ে মাল বুঝিয়ে দেয়াই হলো তাঁর কাজ। অনেকক্ষেত্রে ক্রেতাদের সাথে তাঁর বোঝাপড়াও থাকে।
ক্রেতা-বিক্রেতা যদি সরাসরি বেচা-কেনা করতো তাহলে হয় ক্রেতা ন্যায্য দামে মাল পেত অথবা বিক্রেতা মালের ন্যায্য দাম পেত। কিন্তু দালালের মাধ্যমে লেনদেনটা হওয়ায় পুঁজি ছাড়াই লাভবান হয় দালালের। অন্যদিকে, ‘ন্যায্য’ অধিকার থেকে বঞ্চিত হয় ক্রেতা ও বিক্রেতা।
আন্দোলন মানে কেবল একটা নির্দিষ্ট সময়সীমা ও লক্ষ্যে পৌঁছানো নয়। পৃথিবীর কোনো মানব জাতি তাদের বেঁচে থাকার আন্দোলন থেমে রাখেনি একটা নির্দিষ্ট সময়ের গণ্ডিতে। মানুষ কেবল তার আন্দোলনের ধারা পরিবর্তন করেছে মাত্র। গুহাবাসী থেকে আজ অত্যাধুনিক যুগে প্রবেশ করার সিঁড়িটি হলো কেবল আন্দোলন আর সংগ্রাম। গরু যেমন বেঁচে থাকার জন্য নিরন্তর ঘাস খেতে থাকে। হাঁস-মুরগিরাও তেমনি নিরন্তর খাদ্য খোঁজে গ্রামের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত ঘুরে বেড়ায়। তেমনি সকল পশুপাখিরাও বিরামহীন খাদ্য সংগ্রহ আর গ্রহন চলতেই থাকে তাদের। এরই নামই জীবন সংগ্রাম।
কীট-পতঙ্গ, জীব-জন্তু, পশু-পাখি পৃথিবীর কোনো জীব আন্দোলন-সংগ্রাম ছাড়া টিকে থাকতে পারেনি। যারা আন্দোলন করতে পারেনি, তারা বিলীন হয়ে যেতে বাধ্য। পৃথিবীর ইতিহাসে ডাইনোসর একটি বিশালাকার ও ভয়ংকর জন্তু ছিল। কিন্তু আন্দোলন করতে পারেনি বলে এত্তো বিশালদেহী জন্তু আজ পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছে।
আমেরিকার রেড ইন্ডিয়ান আদিবাসীদের ইতিহাসের কথা কে না জানে। রেড ইন্ডিয়ান আদিবাসী জাতিরা তাদের মৃত্যুর আগ মুহুর্ত পর্যন্ত আন্দোলন করে গিয়েছিল। কিন্তু আন্দোলনের প্রক্রিয়া সঠিক ছিল না বলে আজ তারা পৃথিবীতে অনুপস্থিত।
অনেকের প্রশ্ন থাকতে পারে, পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম আদিবাসীরাও এক থেকে দুই, দুই থেকে তিনটি দলে বিভক্ত হয়েছে। তিনটি দলের অন্তত দুই রকমের দাবি করা হচ্ছে সরকারের কাছে। আর এ কারণেই সরকার চুক্তি বাস্তবায়নে গরিমসি করছে। এই যদি হয় সরকারের অজুহাত তাহলে কেনো সাথে সাথে চুক্তি বাতিল করা হলো না? কারণ, চুক্তি স্বাক্ষরের আগে থেকেই বিএনপি এর বিরোধীতা করেছিল। প্রথম থেকেই লংমার্চ করেছিল। প্রথম থেকেই জুম্মদের ক্ষুদ্র একটি অংশ চুক্তির বিরোধীতা করেছিল। যা চুক্তি স্বাক্ষরের পরের বছর একটি চুক্তি বিরোধী সংগঠন হিসেবে মর্যাদা পায়। যখন দেখা গেল, চুক্তির বিরোধী পক্ষ তৈরি হয়েছে তখন এই চুক্তি সম্পাদন করার কোনো মানে ছিলো না। সাথে সাথেই স্বাক্ষরের আগে তা বাতিল করা উচিত ছিল। এখন এতটা বছর অতিক্রম করে এসে সরকার বলছে, আগে জুম্মদেরকে এক হতে হবে, পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙালিদের সংগঠনগুলো বিরোধীতা করছে, ইউপিডিএফ বিরোধীতা করছে ইত্যাদি ইত্যাদি অজুহাত।
‘পার্বত্য চট্টগ্রাম সমঅধিকার আন্দোলন’ বা বাঙালি ছাত্র পরিষদের কথাই যদি বলি, তাহলে আমাদেরকে চুক্তির ধারায় আবার প্রবেশ করতে হবে। চুক্তির ধারা অনুযায়ী সমঅধিকার বা বাঙালি ছাত্র পরিষদ সংগঠনগুলোর বহনকারীরা পার্বত্য চট্টগ্রামের অবৈধ নাগরিক। যেহেতু চুক্তির মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামকে একটি স্বায়ত্ত শাসিত অঞ্চলের মর্যাদা দেয়া হয়েছে। আর এ মর্যাদা প্রদানের সাথে সাথে পূনর্বাসিত(সেটলার) বাঙালিদেরকে এ অঞ্চলের অবৈধ নাগরিক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সুতরাং, এদের এই অঞ্চলে অবস্থান করে সংগঠন করার কোনো অধিকার রাখে না। আর সরকার এই অবৈধ নাগরিকদের অলিখিত দাবি মেনে একটি লিখিত ও ওয়াদা করা চুক্তির বাস্তবায়নের অন্তরায় হিসেবে দাঁড় করানোর অপচেষ্টা করছে বারবার। আমি একজন পার্বত্যবাসী ও একজন জুম্ম জাতির সদস্য হিসেবে স্বায়ত্ত শাসনের ক্ষমতার অধিকারী হলে যতটা আমার জন্য ভাল আর পূর্ণ স্বায়ত্ত শাসনের ক্ষমতা পেলে আরো বেশি ভাল ও মঙ্গল হবে বলে মনে করি।
এখন যদি বলি, ইউপিডিএফ’র দাবিসমূহ যৌক্তিক কি না তা আমার লেখার বিষয়বস্তু নয়। আমার বক্তব্য হলো আন্দোলনের মাধ্যমে আদায় করা কোনটা যৌক্তিক? তবে, তাদের দাবিসমূহ সম্পূর্ণ সরকারের কাছে। সরকার চাইলে তাদের দাবি মেনে নিতে পারে অথবা না। কিন্তু এটা মনে রাখতে হবে চুক্তিটি ছিল একটা লিখিত ও কমিটমেন্টেড চুক্তি।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিকে নিয়ে সরকারের দুটো অপশন রয়েছে মাত্র। হয় চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করা, না হয় এই চুক্তিকে বাতিল ঘোষণা করা।
ইউপিডিএফ-জেএসএস’র মধ্যকার হানা-হানির অভিযোগে সরকার যা করছে তা হলো পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিক শাসন অব্যাহত রাখা। চুক্তি স্বাক্ষরের পর পাহাড়ের কোনো অবৈধ বন্দুকধারী দ্বারা সরকার বাহিনীর সদস্য বা সাধারণ মানুষ ক্ষতির(হত্যা বা খুন) সম্মুখিন হয়নি আজো। যা হয়েছে তা সারাদেশের দৈনন্দিন ঘটনার তুলনায় অনেক কম। এখানে যা হচ্ছে, তা হলো নিজেদের মধ্যে ভূল বোঝাবুঝির ঘটনা মাত্র। আর এটাকে পুঁজি করে সরকার এখানে সামরিক শাসন অব্যাহত রেখে একটি গোপন আইনে নিয়ন্ত্রণ করা কোনো যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া যায় না। অভিযোগ রয়েছে, সরকারই বিভিন্ন কৌশলে চুক্তির বিরোধী পক্ষ দাঁড় করিয়ে, সেল্টার দিয়ে চাঁদাবাজি, অপহরণসহ বিভিন্ন অপকর্ম চালাচ্ছে। অভিযোগকারীদের ভাষ্যমতে, সরকার চাইলেই এ অঞ্চলের কথিত সন্ত্রাসীদের চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে নির্মূল করতে পারে। কিন্তু সরকার ইচ্ছা করেই এ সমস্যাকে জিইয়ে রেখেছে। এই সৃষ্ট সমস্যাকে পুঁজি করেই পার্বত্য চট্টগ্রামে দায়িত্বরত সেনাবাহিনীরা ‘শান্তকরণ’ প্রকল্পের অনুকূলে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। সেনাবাহিনী বা সরকার চায় পার্বত্য চট্টগ্রামে সন্ত্রাসী কার্যক্রম অব্যাহত থাক। সন্ত্রাস বা সন্ত্রাসী কার্যক্রম না থাকলে এখানে সেনাবাহিনী অবস্থানের কোনো স্কোপ নাই।
এখন মূল বক্তব্য হচ্ছে, সরকার তাঁর প্রদত্ত ওয়াদা অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বাস্তবায়ন করলেই এখানকার সকল সমস্যা দূর হতে বেশি সময় লাগার কথা নয়।
সবশেষে, সকল ছাত্র বন্ধুদের আহবান জানাতে চাই, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পত্রটি যেন পুঙ্খানুপুঙ্খুভাবে পড়ে দেখে এর ধারা-উপধারা বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নেয়ার ভার আপনাদের ঘাড়ে নিতে হবে। এই চুক্তির প্রতিটি শব্দ গবেষণার দাবি রাখে। ব্যাপক অধ্যয়নের দাবি রাখে। এই চুক্তিকে নিয়ে তোমাদের মতো তরুন ছাত্র সমাজকে অনেকে ভূল ধারণা দিয়ে থাকতে পারে। তোমাদেরর আন্দোলনে চলার পথকে বিচলিত করে থাকে একটি কুচক্রীমহল। তারা হয়তো তোমাদেরকে কিছু অসম্ভব ও অকল্পনীয় স্বপ্নের কথা বলে বিভ্রান্তি করার অপচেষ্টা করে থাকতে পারে।
অসম্ভব কিছু পেলে আমাদের কারোর ক্ষতি নয়। কিন্তু যেটা আমি পাবো না, তাকে পাবার আশায় নিজের লালিত স্বপ্নকে যেন হত্যা করা না হয়।
লেখক: পাপেন ত্রিপুরা,সাংবাদিক।
সূত্র :ফেসবুক ।