রবিবার, ১৩ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২৮শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নবগঠিত এবি পার্টি নিয়ে কিছু পর্যবেক্ষণ

জাকির মজুমদার 


বিভিন্ন পর্যায়ের প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য আলোচনায় যে বিষয়টি এখন প্রায় উঠে আসে তা হলো, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার নিজেরাই তাদের নিজেদের জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার প্রমাণকে খুব বাজেভাবে উপস্থাপন করেছে। ওইসব আলাপচারিতায় জনমনের একটিই প্রশ্ন- মহান স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দেশের প্রাচীন এ দলটি কেন বিতর্কিত নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে পাওয়া ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করবে।

কিন্তু প্রশ্ন হলো- আওয়ামী লীগের বিপরীত কার ওপর ভরসা করবে দেশের জনগণ, বিএনপি? অথবা ঐক্যফ্রন্ট? জনগণের মনন-বিবেচনায় বা তাদের আদালতে এরাও ব্যর্থ। সুতরাং বলা যায় বিএনপি বা ঐক্যফ্রন্টের ওপর মানুষের ভরসা তলানিতে। কিন্তু বিকল্পও তো নেই। তাহলে নবগঠিত এবি পার্টি কি সেই বিকল্প হওয়ার তাগিদেই বহু দলীয় রাজনীতির এই ক্ষরায় এবং বৈশ্বিক মহামারির মধ্যেই রাজনীতির ময়দানে সরব উপস্থিতি জানান দিলো? তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে, তাদের আগমন কিছুটা হলেও সাড়া ফেলেছে বিভিন্ন পর্যায়ের আলোচনা-সমালোচনায়। আর তাই এবি পার্টির কর্মকৌশলই বলে দিবে ভবিষ্যতে তারা কতোটুকু স্বার্থক রাজনৈতিক দল হিসেবে রাজনীতির মাঠে অবস্থান করবে।

তবে হ্যাঁ, স্বার্থক রাজনৈতিক দল বলতে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়াকে অথবা ক্ষমতার খুব কাছাকাছি থাকাকেই বুঝায় না। জাতি গঠন, রাষ্ট্র গঠন ও জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখা ও একটি কার্যকর রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে কাজ করতে পারাই মোদ্দা কথা।

বলছি বিএনপি বা ঐক্যফ্রন্টের কথা। ঐক্যফ্রন্ট গঠনের পর তারা এমন কোনো ক্যারেশমেটিক নেতৃত্ব তো দূরে থাক, আকাঙ্খা থাকা সত্ত্বেও সাধারণ মানুষকে আন্দোলন-সংগ্রামে সম্পৃক্ত করে সরকারের বিরুদ্ধে জমে থাকা ক্ষোভকে কাজে লাগাতে পারেনি। বরং সংখ্যাধিক্য পাবলিক পারসেপশন হলো- বিএনিপি ও ঐক্যফ্রন্টের ব্যর্থতার কারণেই তাদের ঘুমে রেখে ২০১৮ এর ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন ২৯ ডিসেম্বর দিবাগত রাতে সুবহে সাদেকের আগেই সম্পন্ন হয়েছে। মানুষ তাদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এর প্রতিক্রিয়াও যে জনগণ দেখিয়েছে, তার উদাহরণ পরবর্তী কয়েকটি উপনির্বাচন, উপজেলা নির্বাচন ও সিটি করপোরেশন নির্বাচনে লক্ষ্য করা গেছে। জনগণ ধরেই নিয়েছে তারা তাদের মনোনীত প্রতিনিধিকে নির্বাচিত করতে অবাধ সুযোগ ও অধিকার ফলাতে পারবে না, তাই তারা পরবর্তীতে ওইসব নির্বাচনে ভোটকেন্দ্র বিমূখ হয়েছে। এমনকি ক্ষমতাসীন দলের ভোটাররাও এখন আগাম বুঝতে পারছে ভোটের ফলাফল কি হতে যাচ্ছে, তাই তারাও ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার তাগিদ অনুভব করছে না। ফলে সাম্প্রতিক সময়ের নির্বাচনগুলোতে ফাঁকা ভোট কেন্দ্রের চিত্রই শুধু সোশ্যাল মিডিয়া ও মূলধারার গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। অথচ এমন অবস্থায়ও বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্ট জনগণকে সম্পৃক্ত করে সরকারের বিপক্ষে ন্যূনতম প্রতিরোধ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে। গত দেড় দশক ধরে বিএনপির সাংগঠনিক দুর্বলতা, নিজেদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা, নেতৃত্বের সংকট মানুষকে বিএনপির ওপর থেকে ভরসাচ্যুত করেছে। ক্ষমতা থেকে দেড় দশক বিচ্ছিন্ন থাকার পরও সর্বস্তরে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে জর্জরিত দলটি।

এমন অবস্থায় সত্যিই কোনো ক্যারেশমেটিক নেতৃত্ব অথবা কোনো একটি দলের সামনে আসা জরুরি হয়ে পড়েছে বলেই সাধারণে এমন একটি মিথ তৈরি হয়েছে। যাদের ওপর সত্যিকারভাবে সাধারণ মানুষসহ সমাজের সচেতন নাগরিক এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদেরও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থন থাকবে, একটি স্বপ্ন তৈরি হবে। তাহলে সেই দলটি কি এবি পার্টিই হতে যাচ্ছে? হয়তো তাই, আবার হয়তো বা না। তবে আমার ধারণা, এবি পার্টি দফায় দফায় বৈঠক, সভা-সেমিনার ও সাধারণ মানুষের সাথে মিশে তাদের পারসেপশন ধারণ করে কর্মকৌশল ঠিক করতে পারলে হয়তো আগামীতে তারাই জনগণের একটি বড় অংশের ভরসার জায়গা হয়ে উঠতে পারে। এজন্য এখন থেকে এবি পার্টিকে শুধু রাজধানী কেন্দ্রিক নয়, বিভাগ জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সাধারণ মানুষদের নিয়ে বৈঠক, সভা, জনকল্যাণ ও জনসম্পৃক্ত কর্মকাণ্ড এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়নে মনোযোগী হওয়া জরুরি। স্থানীয় পর্যায়ের নাগরিক সমাজ, স্থানীয় মিডিয়ায় এবি পার্টি তাদের লক্ষ্য উদ্দেশ্য কর্মসূচি বেশি বেশি করে তুলে ধরার ব্যবস্থা করতে পারে। নিজেদের রাজনৈতিক লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও কর্মসূচি জানান দিতে সাধারণ মানুষের মাঝে লিফলেট বিতরণেরও কর্মসূচি নিতে পারে। এতে তৃণমূল পর্যায়ে এবি পার্টির বিষয়ে জনমত সৃষ্টি হওয়ার সুযোগ তৈরি হবে।

জামায়াতে ইসলামি আনুষ্ঠানিকভাবে এবি পার্টির সমালোচনা বা বিরোধীতা না করলেও দলটির নেতাকর্মীরা ব্যক্তিগতভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জামায়াতের সংস্কারপন্থীদের নেতৃত্বে নবগঠিত এ দলটির প্রতি প্রচণ্ড সমালোচনামুখর। অন্যদিকে এবি পার্টি নিয়ে  আওয়ামী ঘরণার লোকদের সমালোচনা এবং নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিকেও দলটির জন্য ইতিবাচক মনে করছি। এর মাধ্যমে মূলত প্রাথমিকভাবে সাধারণ ও সচেতন মানুষের কাছে এবি পার্টির নিজস্ব স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্যই ফোকাস হচ্ছে। যেমন- এবি পার্টি জামায়াতের বি-টিম অথবা তাদের ছায়া সংগঠন- যারা এমনটি প্রচার করতে চায় এবি পার্টি নিয়ে জামায়াতের লোকদের তীব্র সমালোচনা সেই প্রচারণাকে সাধারণ মানুষের কাছে অবিশ্বাসযোগ্য করে তুলছে বা তাদের দাবি ধোপে নাও টিকতে পারে। একইভাবে যারা মনে করছে বা প্রচার করতে চাচ্ছে- এবি পার্টি সরকারের কোনো গোপন এজেন্ডা বাস্তবায়ন বা সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় সংগঠিত! অথচ আওয়ামী ঘরণার লোকদের সমালোচনা এবি পার্টির বিষয়ে সাধারণ মানুষের সেই বিভ্রান্তি কাটাতেও সহায়ক হচ্ছে।

এমন পরিস্থিতিতে এবি পার্টিকে যে বিষয়ে সবচেয়ে বেশি মনযোগী হতে হবে তা হলো- এন্টি আওয়ামী লীগ সেন্টিমেন্টকে কাজে লাগানো। ওইসব লোকদের কাছে কিছুটা দ্রুত সময়ের মধ্যে দলটিকে আস্থার জায়গা তৈরি করার কৌশল খুঁজতে হবে। কারণ আওয়ামী লীগ বিরোধী মানুষ ধীরে ধীরে বিএনপির ওপর থেকেও তাদের ভরসা হারিয়ে ফেলছে। তাই আওয়ামী বিরোধী শক্তির ইউটার্ন হয়ে উঠার প্রক্রিয়াকে অত্যন্ত কৌশলী হয়ে এগিয়ে নিতে হবে এবি পার্টিকে। মানে আমি যেটা বলতে চাচ্ছি- জামায়াতের লোকেরা না হলেও বিএনপি বা সমমনা দলের নেতাকর্মী, সাধারণ সমর্থক, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি ও বুদ্ধিজীবীদের আস্থার জায়গাটি দ্রুতই সৃষ্টি করতে হবে এবি পার্টিকে। এ জন্য নবগঠিত এ দলটিকে স্টেপ বাই স্টেপ এগুনোর কৌশলও নির্ধারণ করতে হবে।

এবি পার্টি মহান স্বাধীনতার মৌলিক চেতনাকে ধারণ করেই তাদের রাজনৈতিক আদর্শকে এগিয়ে নিতে চায়, তারা অধিকারভিত্তিক কল্যাণ রাষ্ট্র গঠন ও রাজনীতি করতে চায়- এটি সময়োপযোগী।

এবি পার্টি যেহেতু কল্যাণ রাষ্ট্র গঠনের কথা বলছে- সেহেতু দলটিকে কল্যাণ রাষ্ট্র গঠনের স্পিডটা কি হবে অথবা এর ভিত নির্ধারণ করতে হবে। কারণ কল্যাণ রাষ্ট্র গঠন করতে হলে একই সঙ্গে নৈতিকবোধ সম্পন্ন রাজনৈতিক নেতৃত্ব, জনপ্রতিনিধিত্ব এবং জনপ্রশাসন, নিরাপত্তা বাহিনীর নৈতিক সংস্কারের বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত। আরেকটি বিষয় উল্লেখ্য, শুধুই কল্যাণ রাষ্ট্রের বিষয়টিক প্রাধান্য না দিয়ে জনগণকে ‘সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও কল্যাণ রাষ্ট্র’ গড়ার ম্যাসেজ দেয়া যেতে পারে। আরেকটু বিস্তৃত করেও বলা যেতে পারে। যেমন, এবি পার্টি বলতে পারে ‘সকল ক্ষেত্রে নাগরিকদের সেবা পাওয়ার নিশ্চয়তা, সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও কল্যাণ রাষ্ট্র গঠন’ তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচির অন্যতম এজেন্ডা।

সর্বশেষ যেটি বলতে চাই, বর্তমান আঞ্চলিক ও ভূ-কৌশলগত অবস্থার দিক থেকে বাংলাদেশে যেকোনো দলের জন্য আন্তর্জাতিক রাজনীতি, জাতীয় এবং আঞ্চলিক স্বার্থ ও রাজনীতির বিষয়ে গোলকধাঁধাঁর মতো অবস্থায় পড়তে হচ্ছে। আঞ্চলিক রাজনীতিতে চীন-ভারতের নেতৃত্বের লড়াই, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক লড়াইয়ে চীনের আধিপত্য বৃদ্ধি এবং আঞ্চলিক রাজনীতি ও অর্থনীতিতে চীনের প্রভাব মোকাবেলায় ভারতের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের দুস্তি প্রকাশ্য। এমতাবস্থায় মুসলিম প্রধান দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে এবং এদেশের প্রথম সারির দলগুলোকে অত্যন্ত কৌশুলি হওয়া ছাড়া উপায় নেই। এখানে যেমন ভারত বিরোধী হওয়া বা চীনের প্রতি নমনীয় হওয়ার সুযোগ নেই, তেমনি ভারতের প্রতি নমনীয় বা চীনের প্রতি বৈরি হওয়ারও সুযোগ নেই। এই দুই দেশকে ঘিরেই এখন দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট রাজনীতি ও অর্থনৈতিক ইস্যুতে দুটি বলয় সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের বলয়ে থাকা ভারত, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া এবং সৌদি আরবসহ তাদের মিত্র এবং একই সঙ্গে চীন বলয়ে থাকা রাশিয়া, উত্তর কোরিয়া, পাকিস্তান এবং ইরানের মিত্রদের নীতি বাস্তবায়ন হয়ে থাকে। তাই নবগঠিত দল এবি পার্টিকে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক গড়ার ক্ষেত্রে কারো প্রতি বৈরিতা নয়, সকলের প্রতি সোহার্দ্য ও বন্ধু ভাবাপন্ন নীতি অবলম্বন করার বিষয়টিই অধিকতর শ্রেয় বলে মনে করি। তবে দেশ ও জাতির স্বার্থ, মুসলিম জাতিসত্ত্বা, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা, বিশ্ব মুসলিম ঐক্য এবং অসাম্প্রদায়িকতা ও মানবতা রক্ষার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতাকে প্রধান্য দেয়ার বিষয়টি এড়ানো শোভনীয় হবে না।


জাকির মজুমদার
সাংবাদিক, কলামিস্ট ও সমাজকর্মী।

Comments are closed.

More News Of This Category