শনিবার, ২০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

লাখাদের উত্তাপ ছুঁয়ে গেল বাংলাদেশকেও

জাকির মজুমদার 


লাদাখ নিয়ে চীন-ভারতের উত্তাপ পরোক্ষভাবে বাংলাদেশকেও ছুঁয়ে গেলো। আনন্দবাজারসহ ভারতীয় কিছু মিডিয়ায় বাংলাদেশ নিয়ে মর্যাদাহানিকর প্রচারণার সূত্র ধরে এই উত্তাপের জন্ম। তাই বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্ক, বন্ধুত্ব! ও বিভিন্ন ইস্যুতে ট্রল করতে দেখা গেলো। ভালোই উত্তাপ ছড়ায় দেশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।

প্রসঙ্গত, গত ১৫ জুন ভারতের লাদাখ সীমান্তে চীনা সেনাদের সঙ্গে সংঘর্ষে বিবিসির খবর মতে ভারতীয় ২০ সেনা নিহত হয়। যদিও জার্মানিভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলে জানিয়েছে এতে ভারতীয় ২৩ সেনা নিহত হয়েছে। এছাড়া সংঘর্ষ পরবর্তী চীন-ভারতের সামরিক পর্যায়ের সমঝোতা বৈঠকের পর চীনে আটক ভারতীয় উচ্চপর্যায়ের দুজন কর্মকর্তাসহ ১১ সেনাকে মুক্তি দেয় দেশটি। অপরদিকে এই সংঘর্ষে চীন সেনারাও হতাহতের শিকার হয়েছে। যদিও চীনা কর্তৃপক্ষ বিষয়টি এখনো স্বীকার করেনি। একদলীয় এবং অধুনা একনায়ক শাসন ব্যবস্থায় চীনে নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া অনেক ইস্যুর মতো এই সংঘর্ষে দেশটির সামরিক বাহিনীর ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টিও প্রকাশ করতে পারেনি।

চীন-ভারতের মধ্যে লাদাখ সীমান্ত নিয়ে ১৯৬২ সালেও যুদ্ধ হয়। ওই সময় লাদাখের কারাকোরাম ঘেঁষা বিস্তীর্ণ অঞ্চল চীন সেনারা দখলে নেয়। তখন গালওয়ান উপত্যকায় বোমা বর্ষণে ভারতের ৩৬ সেনা নিহত হওয়ার প্রেক্ষাপটে চীন-ভারতের মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এছাড়া অরুণাচল সীমান্ত নিয়ে চীনের সাথে প্রায় ৪৫ বছর আগে সংঘর্ষে ভারতের ৪ সেনা নিহত হয়। সম্প্রতি চীনের সাথে ভারতের লাদাখে আবারো সংঘর্ষের ঘটনার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ভারতের পাশে থাকবে সেই প্রত্যাশা করতেই পারে দেশটি ও তাদের মিডিয়া। কারণ বাংলাদেশের কাছে গত এক যুগ দিল্লির প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির যোগফলই তাদের আকাঙ্ক্ষাকে বাড়িয়ে দিয়েছে।

 

এদিকে লাদাখ সীমান্ত সংঘর্ষের উত্তাপের মধ্যেই চীন বাংলাদেশকে বিশাল বাণিজ্যিক সুবিধার ঘোষণা দেয়। যাতে নতুন করে ৫ হাজার ১৬১টি পণ্যের শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা পায় বাংলাদেশ। এতে দেশটিতে মোট শুল্কমুক্ত পণ্যের সংখ্যা দাঁড়ায় আট হাজার ২৫৬টি। এর মাধ্যমে চীনে বাংলাদেশের মোট রপ্তানি পণ্যের ৯৭ শতাংশই শুল্কমুক্ত সুবিধার আওতায় আসে। ভারতীয় মিডিয়ার প্রত্যাশা ছিলো- দক্ষিণ এশিয়ায় একঘরে ভারতের পাশে চীন-ভারত সঙ্কটে অন্তত বাংলাদেশকে তারা সাথে পাবে। কিন্তু চীনের বাণিজ্যিক সুবিধা ঘোষণা ভারতের মিডিয়ার কাছে মনে হতেই পারে তাদের প্রত্যাশায় তা (বাংলাদেশকে দেয়া চীনের বাণিজ্যিক সুবিধা) বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই চীনে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সুবিধাকে ভারতীয় মিডিয়ার ভাষায় ‘খয়রাতি’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। গত ২০ জুন আনন্দবাজার পত্রিকার মন্তব্য ‘বাণিজ্যিক লগ্নি আর খয়রাতির সাহায্য’ ছড়িয়ে বাংলাদেশকে পাশে পাওয়ার চেষ্টা চীনের নতুন নয়’। মানে ভারতীয় মিডিয়া বলতে চাচ্ছে এর আগেও ‘খয়রাতি সাহায্য’ দিয়ে চীন বাংলাদেশকে পাশে নিয়েছে?

বাংলাদেশকে নিয়ে ভারতীয় দায়িত্বশীল মিডিয়ার এমন অমর্যাদাকর মন্তব্য মেনে নিতে পারেনি দেশের সাধারণ মানুষ। তাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্ষোভ ও প্রতিবাদের ঝড় উঠে। কিন্তু বাংলাদেশকে নিয়ে এমন অমর্যাদাকর মন্তব্যের জন্য আমাদের রাষ্ট্রের তরফে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়নি। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রতিক্রিয়ার সূত্র ধরে দেশের একটি অনলাইন গণমাধ্যম পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেনের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বিষয়টিকে ভারতীয় মিডিয়ার ‘ছোট মানসিকতার পরিচয়’ বলে মন্তব্য করেন। তার ভাষায়, ‘চীনের শুল্ক ও কোটা সুবিধার বিষয়ে ‘বাংলাদেশকে খয়রাতি’ সুবিধা বলে ভারতের মিডিয়ায় যে শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে- তা একেবারে অগ্রহণযোগ্য, এটি ছোট মানসিকতার পরিচয়।

এদিকে হঠাৎই ফের বাংলাদেশ সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের গুলিবর্ষণের ঘটনা বেড়ে গেলো। গত ১৭ জুন থেকে ২৫ জুন পর্যন্ত তিনজন বাংলাদেশির প্রাণ কেড়ে নিলো বিএসএফ। নওগাঁর সাপাহার আদাতলা সীমান্তে সাপাহার উপজেলার দক্ষিণ পাহাড়ি গ্রামের আবু বক্করের ছেলে আবদুল বারী সান্ত (৪৫), ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট গোবড়াকুড়া সীমান্তে গোবড়াকুড়া গ্রামের মানিক মিয়ার ছেলে আবদুল জলিল (২৬) ও লালমনিরহাটের পাটগ্রামের শমসের নগর সীমান্তে উপজেলার বুড়িমারী ইউনিয়নের মুংলিবাড়ী গ্রামের ভুট্টু মিয়ার ছেলে মিজানুর রহমান (২৬) বিএসএফের হাতে নিহত হলো। এদের প্রথমজনকে ককটেল ছুড়ে এবং বাকি দুজনকে গুলি করে হত্যা করে ভারতীয় নিরাপত্তাবাহিনী (সূত্র- দেশরূপান্তর ও সাম্প্রতিক দেশকাল)। লাদাখ ইস্যুতে বাংলাদেশের বিষয়ে ভারতীয় মিডিয়ার প্রতিক্রিয়া আর দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর বাংলাদেশ সীমান্তে এই তৎপরতা তেমনই প্রতিক্রিয়া নয় তো? স্বাভাবিকভাবেই এমন প্রশ্ন উঠতেই পারে।

আশ্চর্যের বিষয় হলো- একতরফা সীমান্ত হত্যা নিয়ে আমাদের রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ যেমন নির্বিকার, একইভাবে বাংলাদেশের মিডিয়াও এ বিষয়ে ততটা সোচ্চার নয়। প্রায়ই দেখা যায়- ‘বিএসএফের হাতে বাংলাদেশি নিহত’ এমন একটা সাদামাটা সংবাদ প্রকাশ করেই দায় সারে দেশের মিডিয়াগুলো। সীমান্ত হত্যা বন্ধ নিয়ে নিজেদের করণীয় এবং ভারতকে চাপে ফেলতে গণমাধ্যমগুলোর ভূমিকা উল্লেখ করার মতো নয়। অথচ ভারতের সঙ্গে চীন পাকিস্তান নেপাল ভুটান ও মায়ানমারেরও সীমান্ত রয়েছে। কালেভদ্রেও ওই দেশগুলোর সীমান্তে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে তাদের দেশের নাগরিক নিহতের খবর তেমন একটা পাওয়া যায় না। যদি এমনটি ঘটেও তাহলে প্রতিবেশী দেশগুলোর রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এবং মিডিয়ায় প্রচণ্ড প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায়। বিপরীত দিকে সীমান্ত হত্যা নিয়ে বরাবরই আমরা নির্বিকার।

আমাদের তরফে আমরা বলছি ভারত আমাদের বন্ধু। ভারতও কিন্তু বলছে বাংলাদেশ তাদের বন্ধু। কিন্তু ভারত কি তার বন্ধুত্বের নজীর উপস্থাপন করতে পেরেছে? বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মনে এমন প্রশ্ন হরহামেশাই ভেসে উঠে। ফারাক্কাবাদের কারণে আজ বাংলাদেশে যমুনা মরতে বসেছে। যমুনা তীর সংশ্লিষ্ট অঞ্চল মরুভূমির রূপ পরিগ্রহ করছে। তিস্তাসহ আন্তর্জাতিক অভিন্ন নদীগুলোর ন্যায্য পানির হিস্যা থেকে বঞ্চিত বাংলাদেশ। যমুনা-তিস্তা থেকে সৃষ্ট বাংলাদেশের শাখা ও ছোট নদীগুলোও এখন প্রায় মৃত। ফলে উত্তরাঞ্চলসহ দেশের মধ্য ও পশ্চিমাঞ্চলে মরুকরণ দেখা দিয়েছে। অথচ বর্ষায় এই ভারতই যমুনার ফারাক্কা বাঁধ আর তিস্তার গোজলডোবা বাঁধ ছেড়ে দিয়ে বাংলাদেশের ওইসব অঞ্চলকে বন্যার পানিতে তলিয়ে দেয়। মানে যখন আমাদের পানির প্রয়োজন তখন পানি বঞ্চিত থাকে বাংলাদেশ। আর যখন আমাদের প্রয়োজন নেই তখন নিজেদের অতিরিক্ত পানি ছেড়ে দিয়ে আমাদের বন্যার মুখে ঠেলে দেয়া হয়। মানে- বন্ধু রাষ্ট্র! আমাদের ভাতেও মারছে, আবার পানিতেও। আর চীনের যে বাণিজ্য সুবিধাকে ভারতীয় মিডিয়া বাংলাদেশের জন্য ‘খয়রাতি সাহায্য’ বলে বিদ্রুপ করলো, তাদের নিশ্চয় জানা আছে ভারতের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্য বৈষম্যের বিষয়টিও।

আমরা বলবো, আপাতত বন্ধু রাষ্ট্র ভারত বাংলাদেশের সাথে তাদের বিস্তর বাণিজ্য ঘাটতি দূর করুক এবং পণ্য শুল্ক সুবিধা দিয়ে চীনের চেয়েও তাদের ভালোবাসার পরিধির বিষয়টি প্রমাণে উদ্যোগী হতে পারে। একই সঙ্গে সীমান্ত হত্যা বন্ধ এবং যমুনা-তিস্তাসহ অভিন্ন আন্তর্জাতিক ৫৪টি নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা দিয়ে বন্ধুত্বকে প্রশ্নমুক্ত করতে পারে। কারণ, বাংলাদেশের কাছ থেকে  বিগত ১২ বছরে  ভারত তার প্রত্যাশিত সবকিছুই আদায় করেছে। বাংলাদেশের কাছ থেকে ভারতের সবচেয়ে বড় পাওয়া বহুমুখী ট্রানজিট তথা করিডোর সুবিধা, বন্দর ব্যবহারের সুযোগ এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের ৭টি রাজ্যে বিদ্রোহ দমনে বাংলাদেশের সক্রিয় সহায়তা। এমনকি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ভারতের বিভিন্ন ইস্যুতে বাংলাদেশের সমর্থনও উল্লেখযোগ্য। অথচ বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যা নিয়ে ভারতের গড়িমসি বিষয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে অনেকটা অভিমানী সুরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বলতে হয়েছে, ভারতকে যা দিয়েছি- তারা আজীবন মনে রাখবে।

 

দক্ষিণ এশিয়ায় বিগত এক যুগ ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন নিয়ে একটি প্রভাব বলয় তৈরির চেষ্টা করছে। অপরদিকে ভারত-মার্কিন প্রভাব মোকাবেলায় চীনও সক্রিয় রয়েছে। সে সুবাদে চীন অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় বাংলাদেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের বিনিয়োগ বৃদ্ধি করেছে। চীনের বাজারে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ও পণ্য শুল্ক সুবিধাও বাড়িয়েছে। চীনের এমন বাণিজ্যিক কূটনীতি প্রতিবেশী অপরাপর দেশগুলোর জন্যেও দৃশ্যমান। অথচ ভারতের ক্ষেত্রে প্রতিবেশীদের বেলায় বিপরীত চিত্রই ফুটে উঠে। নিজ সুবিধার বেলায় ভারত এক পা খাড়া। তার উপর আবার প্রতিবেশীদের ক্ষেত্রে বড় ভাই সুলভ আচরণ ও আগ্রাসী মনোভাবই লক্ষ্য করা যায়। যার কারণে নেপাল ও ভুটানের মতো দেশেও আজ ভারত প্রভাবহীন। দক্ষিণ এশিয়া মুল্লুকে একঘরে ভারতের পাশে শুধুই বাংলাদেশ।

এখানে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে কিছু বলার প্রয়োজন বোধ করছি। রোহিঙ্গারা সত্যিই বাংলাদেশের গলার কাটা হয়ে উঠছে। মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও বিশ্বাসযোগ্য প্রত্যাবর্তন নিশ্চিতে চীনের সক্রিয় এবং দৃশ্যমান সহযোগিতা প্রয়োজন। রোহিঙ্গা প্রত্যর্পণের বিষয়টি চীনের সদিচ্ছার ওপর অনেকটাই নির্ভর করছে। আঞ্চলিক ও ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতাকে ঘিরে কূটনৈতিক কৌশল নির্ধারণের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার প্রত্যর্পণে চীনকে রাজি করার বিষয়টি অগ্রাধিকার হওয়া উচিত বাংলাদেশের।

জাকির মজুমদার

সাংবাদিক, কলামিস্ট ও সমাজকর্মী।

Comments are closed.

More News Of This Category