সোমবার, ৬ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২৩শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আবারও বর্ণপ্রথা ?

 

জহিরুল চৌধুরী 


আরএসএস (রাস্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ)-এর চিন্তক দীণদয়াল উপাধ্যায় ১৯৬৫ সালে “অবিচ্ছেদ্য মানবতাবাদ” নামে একটি তত্ত্ব তার দলের মূলমন্ত্র হিসেবে গ্রহণ করেন। এর উদ্দেশ্য- সমাজতন্ত্র ও ধনতন্ত্রের বিপরীতে ভারতীয় জাতীয় চরিত্রের একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা।

তখন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের ধর্মনিরপক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের জয়জয়কার। পাকিস্তান যখন আন্তর্জাতিক মোড়ল যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষপুষ্ট, তখন রাশিয়াই ছিল ভারতের একমাত্র মিত্র। ফলে হিন্দুত্ববাদ কিংবা ধর্মীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ধৃষ্ঠতা তখনও ভারতীয় রাজনীতিকদের মধ্যে ছিল না।

সমাজতন্ত্র ভারতীয় সংবিধানের মূলমন্ত্র হলেও দেশটির রাজনীতিবিদরা কখনো সেই পথে পা বাড়ানোর দৃঢ সংকল্প দেখাননি। ফলে মাওবাদী উগ্র পন্থা ও বিচ্ছিন্নতাবাদ ভারতের অথণ্ডতাকে সময়ে সময়ে দূর্বলতর করেছে।

ইন্দিরা ও রাজীব গান্ধীর মৃত্যুর পর কংগ্রেস মূলত গতিহারা নৌকা। তদুপরি একজন ইতালীয় বংশদ্ভূত নারী (রাজীব গান্ধীর স্ত্রী) সোনিয়ার উপর ভরসা করার মত অবস্থা ভারতীয় জনগণের ছিল না। এছাড়া উত্তরে পাকিস্তান ও চীনের যুদ্ধসাজ, দক্ষিণে তামিল জাতীয়তাবাদ, পূর্বে আসামসহ সাতটি রাজ্যের বিচ্ছিন্নতাবাদকে মোকাবিলা করার শক্তি ছিল না ভারতীয় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর।

উপরোক্ত প্রেক্ষাপটে ১৯৮০-র দশক থেকে শুরু হয় হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির উত্থান। কোনো প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক শক্তি কিংবা নেতৃত্বের ভূমিকা এখানে ছিল না। বরং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনেকগুলো উগ্র ও চরম ডানপন্থী দল মিলেই আজকের বিজেপি (ভারতীয় জনতা পার্টি) দলটির সৃষ্টি।

বিজেপির উত্থান পর্বের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বহু জাতি, ধর্ম ও ভাষার রাষ্ট্র ভারতের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের উপাখ্যান। ১৯৮৪ সালের নির্বাচনের সময় বিজেপি “রাম জন্মভূমি”র আন্দোলন শুরু করেছিল।

রামের জন্মভূমি উদ্ধারের জন্য সে সময় উত্তর প্রদেশের অযোধ্যায় “বাবরী মসজিদ” গুরিয়ে দিয়ে বিজেপি তার শক্তিমত্তার পরিচয় দেয়। বেশিরভাগ ভারতীয় এতে খুশি হন। বাবরী মসজিদ ভাঙ্গার আন্দোলন ছিল সিম্বলিক।

১৯৮৫ সালের গুজরাট রায়ট, ১৯৮৯ সালের বোম্বাই রায়ট, ২০০২ সালে আবারও গুজরাট রায়ট, ২০১৩ সালের মোজাফফর নগর রায়ট ইত্যাদির ফলে ভারতীয় জনমনে বিজেপির তেজবীর্য দিন দিন বাড়তে থাকে।

যুক্তরাষ্ট্র প্রথমে (জর্জ বুশের আমলে) গুজরাট দাঙ্গার মহানায়ক নরেন্দ্র মোদিকে নিষিদ্ধ করে। ওবামা এসে সেই নিষেধাজ্ঞা কেবল তুলে নিয়নি, তাকে বক্তৃতা দেয়ার নিমন্ত্রণ জানায় সিনেট এবং কংগ্রেসের উভয় কক্ষে। ফলে দাঙ্গাবাজই হয়ে গেল বিশ্বনন্দিত!

একেই বলে সাম্রাজ্যবাদের খেলা! জানা যায়- মোদীর উপর থেকে এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের জন্য মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষুদ্র একটি দেশের চাপ ছিল ওবামার উপর।

২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে থেকে শুরু হয় “গরু বাঁচাও” আন্দোলন। এর প্রধানতম লক্ষ্য ছিল মুসলিম দমন। বিজেপি তাতে সফল হয়। জনপ্রিয়তাকে নিয়ে যায় তুঙ্গে। মোদীর বিজয় হয় ভূমিধ্বস। গরু বাঁচাও আন্দোলনের নামে মুসলিম নিগ্রহ এরপরও বন্ধ হয়নি।

২০১৯-এর নির্বাচনের আগে কাশ্মীরের পুলওয়ামায় সেনাবহরে আত্মঘাতী বোমা বিস্ফারণের ঘটনা বিজেপির বিজয় রথকে আরো এক ধাপ সামনে ঠেলে দেয়। আবারো ভূমিধ্বস বিজয়। এরই প্রেক্ষাপটে জম্মু-কাশ্মীরের স্বায়ত্ত্ব শাসন কেড়ে নেয়া হলো।

সাম্প্রদায়িক উগ্র পন্থার রাজনীতিকে আমরা বাংলাদেশিরা খুব ভালভাবে চিনি। আমরা ১৯৪৭, ১৯৫২, ১৯৭১, ১৯৭৫- ইতিহাসের প্রতিটি পর্বে সাম্প্রদায়িকতাকে পরাভূত করেছি। এই সত্যকে আরো দৃঢ়তার সঙ্গে উচ্চারণ করেন অমর্ত্য সেন। তিনি বলেন- বাঙালীর ইতিহাস-ঐতিহ্য জড়িয়ে আছে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উপর।

শুধু ৭৫-এর ১৫ আগস্টই নয়, স্মরণ করুন ৬৪ জেলায় একসঙ্গে বোমাবাজী। রমনা বটমূলে বোমা হামলা। ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা, হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ। প্রতিটি ঘটনার পেছনে ছিল অশুভ সাম্প্রদায়িক শক্তির পরিকল্পনা। যাতে বাংলাদেশ একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হয়!

ইতিহাস হয়ত এই বাঙালিদের উপরই দায়িত্ব অর্পণ করেছে। দেখি, আমরা কতটা দায়িত্ব জ্ঞানে এই মূর্খতাকে পরাজিত করতে পারি। হিন্দুত্ববাদের নামে আমরা কি বর্ণপ্রথাকে আবার সাদরে গ্রহণ করব, নাকি হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-জৈন-শিখ সবার মিলিত চেষ্টায় একটি সমৃদ্ধ জনপদ গড়ে তুলবো?

এবার আসি পশ্চিম বঙ্গের সাম্প্রতিক ঘটনাবলীতে। কারণ বাংলা বিজয় এখন মোদীর পরবর্তি টার্গেট! রাজ্যের পুলিশ প্রধান যখন প্রকাশ্য জনসভায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির পায়ে ধরে চুমু খান, সভ্য সমাজে সেটা অপরাধের সামিল। অথচ বর্ণপ্রথায় বিভক্ত ভারতীয় সমাজে এটাই রীতি।

সেই পুলিশ বাহিনীর প্রধানের বিরুদ্ধে আবার ঘুষ, দুর্নীতি এবং অবৈধ পথে টাকা কামানোর এন্তার অভিযোগ! শুধু তাই নয়- বিরোধী বিজেপির কর্মী সমর্থকদের পেটাতেও এই বাহিনী বেপরোয়া।

ভারতীয় গণতন্ত্রের সঙ্গে বর্ণপ্রথায় বিভক্ত সমাজের চালচিত্র সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। আজকের বিজেপি উত্থানের পেছনে বর্ণপ্রথার নাগপাশে সমাজকে ঠেলে দেয়ার প্রয়াস হিসেবে দেখছেন বহু পশ্চিমা বিশেষজ্ঞ।

এর নেতৃত্ব দিচ্ছেন ‘চা ওয়ালা’ নরেন্দ্র মোদী। তিনি কিন্তু উচ্চ বর্ণের নন। আবার দলিতও নন। তাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি উত্তরে বলেন- other backwood caste. অর্থাৎ মোট চারটি বর্ণের পরও ৩০০০ উপ জাতের কোনো একটি থেকে তিনি আগত। তার পূর্বপুরুষ ছিল “তেলী” সম্প্রদায়ের। ঘানিতে তেল উৎপাদন করে বিক্রি করত। এই কাজটিও বংশ পরম্পরায় নিম্ন বর্ণের কাজ।

বর্ণবাদ আর বর্ণপ্রথার মধ্যে পার্থক্য আছে। যুক্তরাষ্ট্রে যখন কালোদের মধ্যে (আফ্রিকান বংশোদ্ভূত) বেকারত্ব কিংবা গৃহহীনের হার সর্বোচ্চ হয়, তখন আমরা একে বলি বর্ণবাদের কুফল। কিংবা কালোরা যখন মাদক কিংবা চুরির সামান্য অপরাধে বছরের পর বছর জেল খাটে, তখন আমরা বলতে বাধ্য হই বিচার ব্যবস্থা বর্ণবাদের কালো থাবা থেকে এখনো মুক্ত হতে পারে নি!

বর্ণবাদকে যতটা খালি চোখে দেখা যায়, বর্ণপ্রথাকে কিন্তু ততটা নয়। আমাদের পাশের ভারত বর্ণপ্রথার নাগপাশে এখনো কতটা আবদ্ধ তা দেশটির রাজনীতি বিশ্লেষণ না করলে বোঝার উপায় নেই। সারাদেশ জুড়ে বিজেপির উত্থানের পরিণামে বর্ণপ্রথার নাগপাশে মানুষকে বন্দী করার অসৎ উদ্দেশ্যই প্রতিফলিত হচ্ছে।

অথচ মুক্তির পথটি যিনি উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন, তিনি ভারতীয় সংবিধানের প্রণেতা বি আর আম্বেদকর। তিনিও একেবারে নিম্ন বর্ণ অর্থাৎ দলিত শ্রেণী থেকে আগত। ভারতীয় সংবিধানে “জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবার অধিকার সমুন্নত রাখার বিধান” যুক্ত হয়েছিল ১৯৪৮ সালে।

ভারতে মোট জনসংখ্যা ১৪০ কোটির মধ্যে মাত্র ৫ শতাংশ ব্রাহ্মণ। ৭ কোটির মত। নেহেরু পরিবারের মত কংগ্রেস এবং অন্যান্য আন্চলিক দলের নেতৃত্ব সবসময় ব্রাহ্মনদের কব্জায় ছিল। ব্যতিক্রম কেবল “বহুজন সমাজবাদী দল”। এটি মূলত দলিত শ্রেণীর একটি রাজনৈতিক দল। এবং এই দলিত শ্রেণীর জনসংখ্যা ভারতীয় মোট জনসংখ্যার ১৫ শতাংশ, অর্থাৎ ২১ কোটির মত।

ভারতের সমাজ জীবনে এই বর্ণপ্রথা বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো। ধারনা করা হয়- অন্তত তিন হাজার বছর আগের। ভারতে হিন্দু আইনের প্রামাণ্য ভিত্তি “মনুস্মৃতি” যা যীশুর জন্মের অন্তত ২ হাজার বছর আগে রচিত হয়। সমাজে কানুন এবং রীতি ধরে রাখার জন্য এই বর্ণপ্রথা প্রবর্তন করা হয়েছিল।

বর্ণপ্রথা হিন্দু ধর্মালম্বীদের চারভাগে বিভক্ত করেছে। যথা- ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শুদ্র। বিশ্ব ভ্রম্মাণ্ডের পরিচালক দেবতা ব্রহ্মা এই চার শ্রেণীকরণ বিভক্ত করে মানব জাতিকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন।

সবার উপর ব্রাহ্মন, এদের অবস্থান ব্রহ্মার মাথায়। এরা শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী এবং ধর্মযাজক। এরপর, ক্ষত্রিয়- এদের অবস্থান ব্রহ্মার বাহুতে। এদের কাজ সৈনিক এবং শাসনকর্তার। তৃতীয় স্তরে- বৈশ্য, উৎপত্তি ব্রহ্মার উরুতে। এদের কাজ তেজারতি ও ব্যবসাপাতি করা। চতুর্থ স্তরের শুদ্র- উৎপত্তি ব্রহ্মার পায়ের নীচে। লেট্রিন পরিষ্কার, জুতা সেলাই, চাবাগানের শ্রমিক, ইত্যাদি নিম্নস্তরের কাজ এদের জন্য নির্ধারিত।

প্রধান বর্ণগুলো আবার বহু গোত্রে বিভক্ত। কর্মভেদে অন্তত আরো ৩০০০ হাজার বর্ণ এবং ২৫ হাজার উপ-বর্ণের অস্তিত্ব আছে ভারতীয় সমাজে। এই বর্ণপ্রথার বাইরেও কিছু লোকের অস্তিত্ব আছে ভারতের সমাজ জীবনে। এরা “অচ্যুত” কিংবা অস্পৃশ্য। হিন্দু ধর্মালম্বী হলেও এদের স্পর্শ করলে ব্রাহ্মনকেও পাপ স্খলনের জন্য যজ্ঞ কিংবা ঈশ্বরকে পুঁজা দিতে হয়।

প্রশ্ন হলো- ভারতীয় জনগণকে বিভ্রান্ত করে বিজেপি কি আবার সেই বর্ণপ্রথাকেই ফিরিয়ে আনতে চাইছে? পুঁজিবাদ কিংবা সমাজতন্ত্রের বাইরে যে ধারাকে বিজেপি ফিরিয়ে আনতে চাইছে, সেটি বর্ণপ্রথা ছাড়া আর কী?

লেখক : জহিরুল চৌধুরী

নিউইয়র্ক

Comments are closed.

More News Of This Category