শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মানুষ ও পুতুলের দ্বৈরথ!

 

সিনহা মনসুর 


মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ট রচনা কোনটি?কেউ বলবেন ‘পদ্মা নদীর মাঝি’।
কেউ বলবেন ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’!আমি বলবো দুটোই! কারন ও দুটোকে বাদ দিলে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ে অচল! মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় আর মানিক থাকেন না।হয়ে যান আমাদের চেনা জানা কেউ।ওই দুটোতেই মানিক অচেনা! বিশেষ করে ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’য়!

চেনা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে হঠাৎ অচেনা বলছি-এর কারন কি? কারন আছে! এক সাক্ষাতকারে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন:
‘সত্যই তো আর পুতুল নয় মানুষ। অদৃশ্য শক্তি বা অন্য অন্য মানুষের আঙ্গুলে বাঁধা সুতোর টানে সত্যই তো মানুষ পুতুলের মত নাচে না’!

কিন্তু তিনি যখন ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’র চরিত্র-চিত্রন করলেন তারা কিন্তু পুতুল হয়ে রইলো।মানুষ-রুপী পুতুল। সূতোর টানে তারা নেচেছে।এই সূতো কখনো দৃশ্যমান, কখনো অদৃশ্য!
মানুষ-রুপী এই পুতুলের দৃশ্য বা অদৃশ্য সূতো কার হাতে?
ভালবাসার মানুষের হাতে?
পরিবারের হাতে?
সমাজের হাতে?
লেখকের হাতে?
নাকি গ্রীক মিথলজীর নিয়তির হাতে?
আমরা উত্তর জানি না।
মানুষ সব জেনেও পুতুল হয়ে থাকে, কখনো সমাজের কাছে, কখনো পরিবারের কাছে, কখনো ভালোবাসার মানুষের কাছে। যেমন কুসুম সাতটি বছর অবহেলার পুতুল হয়ে কাটিয়েছে গাওদিয়া গ্রামে।আবার নিজে থেকে সুতো টেনে গুটিয়ে চলে গেছে বাপের বাড়ি। এমন অনেক নজির মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে আমাদেরকে চোখে আংগুল দিয়ে দেখিয়েছেন।লেখক মানুষের জীবন নামের পুতুল খেলাকে পাঠকের সামনে স্পষ্ট করেছেন।

ওটা ছিল ১৯৩৩ সাল। কলকাতায় কিংস কার্নিভালে পুতুল নাচ দেখতে গিয়েছিলেন লেখক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। ওই পুতুল নাচ দেখে অনুপ্রাণিত হয়েই তিনি রচনা করেছিলেন কালজয়ী উপন্যাস ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’!

বইটিতে মানিক বন্দোপাধ্যায় বলেছেন,এক গ্রাম্য যাপিত-জীবনের গল্প।আপাত দৃষ্টিতে যাকে বৈচিত্র্যহীন,সঙ্কীর্ণ স্বকেন্দ্রিক বলে ভুল হয়।কিন্তু মানিক দেখিয়েছেন এর মাঝেও আছে কত বৈচিত্র্য, কত রহস্য! তারা বাস করে এক ঘোর লাগা জীবনে। পুতুলের মত নেচে যায় তারা।অদৃশ্য কোন শক্তির প্রভাবে।হিন্দু পুরাণে দৈত্যকুলের অত্যাচারী রাজা হিরণ্যকশিপু এবং পুত্র প্রহলাদের কাহিনী পড়েছিলাম।’পুতুল নাচের ইতিকথা’য় পিতা গোপাল আর পুত্র শশী সেই পুরাণের কাহিনীর সমকালীন চিত্ররূপ।

গোপাল তেজারতির ব্যবসা করে। মানুষকে ঠকিয়ে, সর্বনাশ করে সে গাওদিয়া গ্রামে অর্থের সম্রাজ্য স্থাপন করেছে। শশী তার পুত্র। কলকাতা থেকে ডাক্তারী পাশ করে শশী।সে নির্লোভ ও পরোপকারী। গোপাল শত চেষ্টা করেও শশীকে পুরোপুরি বিষয়ী করে তুলতে পারেনি। সময়ের সাথে সাথে লোভ কিংবা পরশ্রীকাতরতা নয়! শশী যা অনুভব করে সেটা হলো একাকীত্ব।শশীর একাকীত্বের বন্ধ দরজায় কড়া নাড়ে কুসুম। একবার, দুবার নয়। কড়া নাড়ে, বার বার! কুসুম, শশীর বন্ধু পরাণের স্ত্রী!

সমাজ, সংস্কার সবকিছুর ভয় ছাপিয়ে কুসুম বলে: ‘সইতে পারি না ছোটবাবু’!
কুসুমের আর্তনাদটা শশী বুঝেছিলো। তবুও সাড়া দেয়নি!
শশী তখন পুতুল!
সমাজ, সংস্কারের ভয়ে দম দেয়া পুতুল!

উপন্যাসের শুরুতে কুসুমের ননদ মতির মাঝেই শশী তাঁর একাকীত্বকে নির্বাসন দিতে চেয়েছিলো। কিন্তু কোথা থেকে কলকাতার বন্ধু কুমুদ এসে সব এলোমেলো করে মতিকে বিয়ে করে নিয়ে যায়। জীবন নিয়ে দুটি মানুষের ছেলেখেলায় সে গল্প, গল্পের মাঝে আরেক গল্প!

শশী নিজের সাথেই দ্বন্দ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়া পরাজিত এক সত্তা।হৃদয় ও আবেগের বশবর্তী হয়েও সে চেয়েছে যুক্তি দিয়ে জীবন চালাতে।তাই সে নিজের কাছে নিজেই পরাজিত হয়। বারবার!
একসময় সে সাড়া দিয়ে চায় কুসুমের ডাকে।কিন্তু তখন ঢের দেরি হয়ে গেছে। কুসুম নামের এক পূজারিণী তার দেবতার দেখা না পেয়ে ফিরে গেছে তারই দুয়ার থেকে। সে আর ফিরবে না!

কল্পনা আর জীবনের বাস্তবতা দুটো দুইধারায় বয়ে চলা নদী। মানুষের সব রঙিন কল্পনা ছাপিয়ে সাদাকালো একাকীত্ব যখন জীবনকে গ্রাস করে তখন মানুষ যাকে কাছে পায় তাকে ঘিরেই বেঁচে থাকতে চায়।
তখন যে মানুষ একটা জড় পুতুলের মত অসহায় হয়ে যায় সে কথা কি মানুষ জানে ?
কেউ কি জানে কিভাবে রংধনুর সাতটি রং থেকে ধুঁয়ে মুছে তৈরি হয় একটি একটি বর্নহীন জীবন?

আমরা তো শশীর আত্মদহন নিয়েই বেঁচে থাকি! বেঁচে থাকি কুসুমের অভিমান বুকে চেপে! নিজের আবেগকে জোর করে অবদমিত করি সমাজ, সংসার আর সংস্কারের বেড়াজালে! এইতো, আমাদের পুতুল নাচের ইতিকথা!

স্বত্বা সব সময়েই বন্দী! প্রেমে বা অপ্রেমে!

Comments are closed.

More News Of This Category