বৃহস্পতিবার, ২৫শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মির্চা দ্যা গ্রেট

মির্চা দ্যা গ্রেট

(একটি অলিখিত উপন্যাসের সারাংশ)

হারুন আল রশিদ 


চুয়াল্লিশ বছর বয়সী মির্চা শেয়ারবাজারে ফটকা কারবার করে ধনী হয়ে যান। এক সময় মির্চা দুই হাজার রোনা দিয়ে দশটা শেয়ার সার্টিফিকেট কেনেন। ওই রোনা আসে তাঁর স্ত্রীর দুটি কানের দুল চুরি করে যা তিনি স্ত্রীকে বিয়ের রাতে উপহার দিয়েছিলেন।

এক কালে মির্চার জীবন দুর্বিষহ ছিল। তিনি ঘরে বসে থাকতেন, ঘুমাতেন, খেতেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা স্ত্রীর বেতনের টাকায় শস্তা কাপড় কিনে তা পরতেন। স্ত্রী যখন তাঁকে গালিগালাজ করতেন তখন তাঁর বোন আর মা হাসাহাসি করতেন। মা যখন তাঁকে উত্ত্যক্ত করতেন তখন বোন তাঁর পক্ষ নিতেন। বোন যখন তাঁকে উত্ত্যক্ত করতেন মা তখন তাঁর পক্ষ নিতেন।

ভাদাইম্যার মাগ যায়।
খাণ্ডারি ভাতার খায়।।

ছেলের বউ কাজে গেলে মির্চার মা মির্চাকে খনার বচন শোনান। আর জিজ্ঞেস করেন, তোর কি ওইটা নাই, থাকলে তুই ঘরে বসে থাকস ক্যান? ছোটবেলায় তোরে যখন গোছল দিতাম তখনতো দেখছি ওইটা আছে। বিয়ার পর কি হাত দিয়া খোয়াইছিস? কিচু না পার মেথরের কামত করবার পারিস।

এক দিন মির্চার মা সহসা চুপ মেরে যান। কারণ খাণ্ডারি, মানে মির্চার স্ত্রী, কাজ থেকে বাসায় ফিরেছেন। মির্চার মা তাঁর ছেলের বউকে কিছু বলার সাহস রাখেন না। কারণ ওই বউয়ের টাকায় তাঁর বহুমূত্র রোগের জন্য বড়ি কেনা হয়।

মির্চা পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন আশাবাদী মানুষ হিসাবে। ঘরে বসে তিনি নীরবে ত্রিশ খণ্ড রচনা অধ্যয়ন করে সুবিধাবাদের উপর পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। মির্চা মধ্যপন্থাকে ঘৃণা করতেন। তাঁর কথা ছিল হয় তিনি সবাইকে ছাড়িয়ে যাবেন, নয়তো সবার পায়ের তলায় পড়ে থাকবেন। বাপদাদার রেখে যাওয়া মেরামতহীন ইটের ঘরের চার দেয়ালের মধ্যে পচে মরবেন। এক দল খাণ্ডারির গালি খেয়ে কান পচাবেন। প্রতিদিন ভোরে তিনি বাইরে যান, উদীয়মান সূর্যের দিকে তাকান, খবরের কাগজের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে খুঁটে খুঁটে প্রত্যেকটা কাগজ পড়ে বোঝার চেষ্টা করেন অদূর ভবিষ্যতে দেশে কোনও গৃহযুদ্ধ লাগার সম্ভাবনা আছে কি না। মির্চার মনে ধনী হওয়ার অনেক উর্বর পরিকল্পনা ছিল। তবে ফটকা কারবারের কথা তিনি কখনও কল্পনা করেননি।

আশেপাশের দেশগুলি থেকে ফটকাবাজরা এসে মির্চার শহরের শেয়ার মার্কেটে ঢোকেন আর ফটকার কারবার শুরু করেন। মির্চার শেয়ারগুলির দাম সোভিয়েত রকেটের মতো আকাশে উঠতে থাকে। মির্চার এক একটা শেয়ারের দাম যখন এক কোটি রোনায় ওঠে তখন কিছু বন্ধু এসে মির্চাকে তাঁর শেয়ারগুলি বেচে দিতে বলেন। বন্ধুদের চাপের মুখে ডান হাতের তর্জনিতে পরা প্রপিতামহের রেখে যাওয়া পারিবারিক-ভাগ্য আংটির দিকে তাকিয়ে মির্চা তাঁর স্নায়ুর চাপ পরীক্ষা করেন। মির্চার শেয়ারের দাম বাড়ে আর বাড়ে। দূরবর্তী দেশসমূহের ফটকাবাজরা যাঁরা তাঁদের খবরের কাগজগুলির শেষ পৃষ্ঠায় নিচের দিকে ছাপানো মির্চার দেশের শেয়ারের খবর গনায় ধরেননি তাঁরাও পরবর্তী বিমানের শেষ টিকেট কেটে মির্চার শহরে এসে জড়ো হন।

মির্চা তাঁর স্নায়ুর শক্তি পরীক্ষ করে যান। এক দিন সকালে মির্চার এক একটা শেয়ারের দাম ওঠে এক হাজার কোটি রোনায়। সে খবর পেয়ে ছাল ওঠা আরামকেদারায় বসে থাকা মির্চা নড়ে ওঠেন, যেখানে বসে খাণ্ডারিদের গঞ্জনা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য কানে তুলা গুঁজে তিনি বছরের পর বছর পার করে দিয়েছেন। সে দিন দুপুরে মির্চাকে সতর্ক করার জন্য কোনও বন্ধু আসেননি। মির্চার ছিল ছুরির মতো ধারালো উপজ্ঞা। সে দিন অপরাহ্নে মির্চা তাঁর দশটি শেয়ার বিক্রি করে দেন।

পরের দিন শেয়ারের দরপতন শুরু হয়। সেই খবর জঙ্গলের আগুনের মতো শহরে ছড়িয়ে পড়ে। শেয়ার জ্বরে আক্রান্ত মানুষগুলো তাদের শেয়ারের কাগজগুলিকে রাস্তায় ছুঁড়ে মারেন, কাগজের টিলায় আগুন ধরিয়ে দেন, আর একে একে তাঁরা সেই আগুনে ঝাঁপ দেন। সেই শেয়ারবাজার ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় আর সেখানে রয়ে যায় ঐতিহাসিক শেয়ার বিপর্যয়ের চিহ্ন হিসাবে একটা গোরস্থান, মৃতদের স্মরণে নির্মিত একটি হর্ম্য আর একটি আনন্দালয়, যা রাতারাতি স্থাপন করা হয়েছিল শেয়ার জ্বরে আক্রান্ত নব্য ধনিদের জন্য, যাদের শেয়ার বাজারের বিশৃঙ্খলা ছেড়ে নারীর সন্ধানে বাইরে যাওয়ার সময় ছিল না।

এক আনুপুঙ্খিক তদন্তে ওই শেয়ার বাজারের পরিচালকের দাদার লেখা এক চিঠি মনুষ্য সৃষ্ট এই দুর্যোগের কারণ হিসাবে চিহ্নিত হয়। সেই দাদা ঔপনিবেশিক আমলে এক ওলন্দাজ বেপারির ব্যক্তিগত কেরানি ছিলেন। ওলন্দাজ ব্যবসায়ী থেকে দাদা শুনেছিলেন নিউ ইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জের শেয়ার পতনের কাহিনী যা আমেরিকান অর্থনীতিতে মহাবিপর্যয় ঘটিয়েছিল। দাদা নিজেই নিউ ইয়র্কে পালাতে চেয়েছিলেন ফটকাবাজিতে অংশগ্রহণ করার জন্য কিন্তু কুষ্ঠ রোগের কারণে তাঁকে নিউইয়র্ক বন্দরে জাহাজ থেকে নামতে দেয়া হয়নি। চিঠিতে দাদা ফটকা কারবারের আদ্যোপান্ত লিখে যান আর তাঁর নাতি আমেরিকান অর্থনৈতিক মন্দার ছয় দশক পরও ওই কৌশলগুলি কাজ করে কি না তা পরীক্ষা করার জন্য নিজের শেয়ার বাজার ফটকার আগুনে ধ্বংস করেন।

সেই শীতে মির্চা শেয়ার অগ্নিকাণ্ডের পাশে বসে আগুন পোহান আর তাঁর কাঁচা টাকার সুব্যবহারের জন্য পরিকল্পনা তৈরি করেন। মির্চা কয়েকটা ব্যবসা শুরু করেন। তিনি একটা ব্যাংক চালু করেন যা কয়েক বছরের মাথায় ব্যক্তিখাতে বিশ্বের এক নম্বর জাতীয় ব্যাংকের স্বীকৃতি পায়। মির্চা ধনী হতে থাকেন। খবরের কাগজগুলি বর্ণনা করতে থাকে মির্চার ব্যক্তি সত্তা, তাঁর কাছের ও দূরের আত্মীয়স্বজনের গল্প, তাঁর সংগ্রাম ও বুদ্ধিমত্তার কথা, তাঁর ব্যবসায়িক চাল, ঈশ্বরের প্রতি তাঁর বিশ্বাস, শয়তানের প্রতি তাঁর ঘৃণা, তাঁর স্বাস্থ্য, তাঁর রক্তের প্রকৃতি ও উপাদানসমূহের বিন্যাস, তাঁর শরীরচর্চার সময়, তাঁর পায়খানার রং, প্রশ্রাবের গন্ধ, তাঁর মেরুদণ্ডের ত্রুটি, তাঁর দুই বাহুমূলের চুলের সংখ্যা, এবং সর্বোপরি, তাঁর মুখের প্রশস্ত হাসি, যা তাঁকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি প্রদান করে।

বিশ্বের আনাচকানাচ থেকে নিরানব্বই জন অখ্যাত লেখক মির্চার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করতে আসেন তাঁর জীবনী লেখার জন্য। নিরানব্বইটা জীবনীর মধ্যে একাত্তরটা গ্রন্থ একাত্তর জন জীবনীকারকে পৃথিবীব্যাপী পরিচিতি প্রদান করে। ওই একাত্তরটা বই সারা বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের হৃদয় হরণ করে, যতটা না মির্চার ধূর্ততা আর পরবর্তীকালের দাতব্যের জন্য, ততটা তাঁর নিষ্পাপ মুখের প্রশস্ত হাসির জন্য, যা দিয়ে ওই একাত্তরটা বইয়ের প্রত্যেকটার কভার-পেজ বানানো হয়। এক ইতালিয়ান মনোবিজ্ঞানী আবিষ্কার করেন মির্চার ধন নয়, তাঁর মুখের অট্টহাস্য পৃথিবী জয় করেছে । বাকি আটাশটা জীবনী, যেগুলোর কভার-পেজে শেয়ার-সার্টিফিকেটের অগ্নিকাণ্ডের ছবি ছাপানো হয়, সেগুলির প্রত্যেকটা ভাগাড়ে ফেলে দিতে হয়।

নিজ জীবনের অর্থনৈতিক ভিত্তি মজবুত হওয়ার পর মির্চা তাঁর ব্যক্তিগত জীবন ঠিক করার দিকে মনোযোগ দেন। এ কাজ করতে গিয়ে মির্চার মেরুদণ্ড কেঁপে ওঠে। ইতিমধ্যে তাঁর স্ত্রী তালাক চেয়ে আদালতে মামলা করেছেন। জনগণ স্তম্ভিত হয়ে যায়। কারণ এ রকম অবস্থায় স্বামী বয়স্কা স্ত্রী থেকে তালাক চায় তরুণী স্ত্রী গ্রহণ করার জন্য। জানা যায় যে তালাকের সূচনা হয় একটা চিঠি থেকে যা মির্চার স্ত্রী লিখে যান মির্চার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি শুরুর প্রাক্কালে যখন স্ত্রী মির্চার বাড়ি ত্যাগ করেন। বেশ কয়েক বছর পরে, যখন মির্চা সম্পর্কে জনগণের মোহ তলানিতে ঠেকে, তখন এক অনুসন্ধানী সাংবাদিক ওই চিঠিটা উদ্ধার করে তা একটা জাতীয় দৈনিকে ছেপে দেন। চিঠিতে স্ত্রী লিখেছেন:

হে আমার ঘৃণিত স্বামী, আপনি এক বার মাত্র পড়ে এই পত্রখানা ছিঁড়ে ফেলে দিবেন যাতে এটা কোনও অনুসন্ধানী সাংবাদিকের হাতে না পড়ে। শীঘ্রই আমি আপনাকে তালাকের নোটিশ পাঠাব। এটা সত্য যে আপনার অলস দিনগুলিতে আমি আপনাকে অনেক গালমন্দ করেছি। কিন্তু আপনার সাফল্যের পর আপনার সাথে থাকা আমার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এখন আমি আপনাকে আগের যে কোনও সময়ের চেয়ে বেশি ঘৃণা করি। যদি আপনার হৃদয় একজন লুটেরার হৃদয় না হত শত আলস্য সত্ত্বেও আমি আপনাকে আমার বুকে জড়িয়ে রাখতাম। কিন্তু আমার পক্ষে কখনওই একজন প্রতারকের সাথে বাস করা সম্ভব নয়। আমি যদি দেখি আপনি হলিউড আর বলিউডের সব নায়িকার সাথে ঘুমাচ্ছেন তবুও আমি আপনাকে ঈর্ষা করব না। আমি গর্বিত যে আমি আপনাকে তখনও প্রত্যাখ্যান করেছি যখন আমার শরীরের বাঁধন বেগুনের মতো টাকটা ছিল। আমি আপনাকে এতটাই ঘৃণা করি যে আমি আপনাকে পুনরুত্থানের দিন ঈশ্বরের সামনেও অস্বীকার করব।

তালাকের মীমাংসা হিসাবে মির্চা তাঁর স্ত্রীকে রাষ্ট্রের আইন ও ঈশ্বরের আইনে প্রাপ্ত ক্ষতিপূরণের একশ গুণ রোনা দিতে চেয়েছিলেন। তাঁর তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রী এক রোনা নিতেও অস্বীকার করেন। স্ত্রী ভাঙ্গা একটা বাড়ির একটা পুরনো কক্ষ ভাড়া নিয়ে তিনি এবং তাঁর মেয়ে রোদালিকা তাঁর শিক্ষকতার স্বল্প বেতনের উপর নির্ভর করে নতুন জীবন শুরু করেন।

একুশ বছর বয়সের পুশমিত নারী রোদালিকা মায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। রোদালিকা অভিযোগ করেন এই বলে যে তাঁর মা তাঁকে অভাবঅনটনের মধ্যে টেনে এনেছেন এমন এক সময়ে যখন তিনি এক রাজকুমারীর জীবন যাপন করার সুযোগ পেয়েছেন। তিনি তাঁর মাকে জানিয়ে দেন যে তাঁর পক্ষে বর্ণনা করা সম্ভব নয় তাঁর পিতার টাকায় বিলাসিতার জীবন শুরু করা তাঁর দাদি ও পিসিকে তিনি কতটা হিংসা করছেন যখন ওই দুই নারী মির্চার সাথে সম্পর্কে রোদালিকার থেকে দূরে যেহেতু তাঁরা কেউ মির্চার ঔরসে জন্মগ্রহণ করেননি। মাকে দেয়া রোদালিকার গালিগুলি ওই গালিগুলির চেয়ে বেশি ধারালো ও বিদ্রুপাত্মক ছিল যেগুলি মির্চার স্ত্রী মির্চার বেকার জীবনে তাঁর উপর বর্ষণ করতেন। রোদালিকা বলতে থাকেন তাঁর মা ডাইনি আর তাঁর পিতা সন্ত। তাঁর মার দেহের রস অকালে শুকিয়ে গেছে। তা না হলে তিনি নিজের স্বামীকে অত অবহেলা করতে পারতেন না। তাঁর পিতা বহু বছর কোনও কামনা অনুভব করেননি কারণ তাঁর বিষাক্ত স্ত্রীর গঞ্জনার কারণে তিনি বিচলিত ও আত্মবিশ্বাসহারা হয়ে পড়েছিলেন। যখন তাঁর সুদিন এল এবং তিনি নারীর জন্য পুনরায় কামনা অনুভব করা শুরু করলেন, যা একটা পুরুষের জন্য স্বাভাবিক, তখন তাঁর মার নিবেদন করার মতো কিছু বাকি রইল না। রোদালিকা বললেন কঠিন জীবন পেরিয়ে আসা তাঁর পিতাকে তিনি এক বিন্দু দোষ দিবেন না যদি পিতা এখন এমনকি এক হাজার পূর্ব ইউরোপিয়ান সুন্দরী তরুণীকে বিয়ে করেন যেমন করেছিলেন আফ্রিকার স্বৈরশাসক লেফটেনেন্ট কর্নেল মোহাইমেনাল আদাগি । এক দিন সকালে মির্চা তাঁর মেয়ে রোদালিকাকে দেখতে এলে রোদালিকা পিতার বাহুতে ঝাঁপ দেন আর তাঁকে তাঁর মায়ের নিপীড়ন থেকে রক্ষা করার জন্য আহ্বান জানান।

সেই সকালে রোদালিকা তাঁর মায়ের দারিদ্র্য ত্যাগ করে তাঁর পিতার জৌলুসে প্রবেশ করেন।

তত দিনে মির্চা নতুন স্ত্রী গ্রহণ করেছেন। তাঁর জীবনের সাফল্যের পূর্বেই তাঁর এ পরিকল্পনা করা ছিল। প্রথম স্ত্রীর সাথে তালাক হয়ে যাওয়ার পর মির্চার প্রথম লক্ষ্যই ছিল একটা উপযুক্ত নারীকে বিয়ে করা। তাঁর নতুন নির্মিত অফিস ভবনে মির্চা প্রথম যে সভা করেন তা ছিল শহরের ঘটকদের সাথে যাঁদের অনেকে মির্চাকে উনিশ বছরের একটা তরুণী বিয়ে করার প্রস্তাব দেন। মির্চা রাজি হননি। ‘আমার মেয়ের বয়স একুশ,’ মির্চা বলেন। ‘আমি চাই না দুনিয়া আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করুক।’ মির্চা ঘটকদের পঁয়ত্রিশ বছরের এক নারী খুঁজে বের করতে বলেন, যাঁর পেশি হবে নিটোল, বক্ষ হবে টানটান। যাঁর হাত হবে সুডৌল আর পা হবে দীর্ঘ। যে কখনও সন্তান প্রসব করেনি। মির্চা জানতেন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নারীর বুক মাটিতে নামানোর জন্য এক সন্তানই যথেষ্ট। এক ঘটক মির্চার বিয়ের জন্য এক বিখ্যাত থিয়েটার অভিনেত্রীকে খুঁজে বের করেন।

খুব দ্রুত মির্চার ব্যাংক অলৌকিক ঘটনা ঘটাতে শুরু করে আর মির্চার নাম পৃথিবীর প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলিতে পৌঁছে যায়। অর্থলোভী পৃথিবীতে ওটা ছিল একটা নতুন আবিষ্কার। মির্চা দরিদ্রতম নারীদের মধ্যে যাঁরা দরিদ্র তাঁদের জামানত ছাড়াই ঋণ দিতে শুরু করেন। পৃথিবীর তাবৎ ঋণদাতারা অবাক হন: কী করে একটা ব্যাংক জামানত ছাড়া ঋণ দিতে পারে? বিহ্বল অবস্থায় তাঁরা বুঝতে ব্যর্থ হলেন যে মির্চার দেয়া ঋণের অর্থ অতি সামান্য। অন্যদিকে মির্চার ঋণ আদায়ের পরিকল্পনা ছিল ঋণ প্রদানের পরিকল্পনা থেকে অনেক বেশি উর্বর। মির্চা ঋণগ্রহিতাদের বেশি বেশি পরিশ্রম করার জন্য উৎসাহ দিতে থাকেন যাতে তাঁরা ঋণ পরিশোধ করতে পারেন। যাঁদের আগে কোনও খাবার ছিল না তাঁরাও মির্চার টাকা লগ্নি করে কিছু খেতে পান। যেহেতু তাঁদের ঋণ পরিশোধ করতে হবে সেহেতু তাঁরা দিনরাত পরিশ্রম করেন। এমন পরিশ্রম যা দাসপ্রথার যুগে কখনও কোনও আফ্রিকান দাস আমেরিকান অঙ্গরাজ্য জর্জিয়ার নিষ্ঠুরতম মালিকের অধীনেও করেননি। তারপরও ওই নারীদের বাউণ্ডুলে স্বামী আর অলস পুত্রগণ মির্চার জন্য প্রার্থনা করেন কারণ মির্চার কারণে তাঁরা অন্তত এক বেলা খাবার পান।



মির্চা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বীরে পরিণত হন। ‘অন্তত সেতো গুণ্ডা পালে না।’ সমালোচকরা রাজনীতিবিদদের প্রতি কটাক্ষ করেন। ফ্লোরেন্সে আধুনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার উত্থান ও পতনের পর থেকে মানবজাতির ইতিহাসে মির্চা তাঁর ক্ষুদ্রঋণের জন্য সর্বোচ্চ সুদের হার ধার্য করেন, কিন্তু এ বিষয়ে কেউ কিছু বলার সুযোগ পেলেন না, কারণ মির্চা তাঁর ঋণগ্রহিতা শ্রেণির পুরুষদের মতো পোশাক পরা শুরু করেন। তিনি তাঁরা আলিশান অফিস ভবনে বিশিষ্ট পাদ্রিদের আমন্ত্রণ করে জিজ্ঞেস করেন, শাস্ত্রমতে তাঁর জন্য কতটুকু পোশাক অপরিহার্য। প্রধান পাদ্রি মির্চাকে দাঁড়াতে বলেন আর তাঁর দেহের উপরের অংশ অনাবৃত করতে বলেন। তারপর প্রধান পাদ্রি হাত দিয়ে দেখিয়ে দেন মির্চাকে তাঁর দেহের কতটুকু আবশ্যিকভাবে ঢাকতে হবে: নাভির এক চুল উপর থেকে দুই হাঁটুর এক চুল নীচ পর্যন্ত। পরবর্তী দিন সকালে পৃথিবীর সকল সংবাদপত্র মির্চার নতুন পোশাক তাদের প্রধান শিরোনাম করে আর মির্চার প্রায় উলঙ্গ দেহের ছবি ছাপে যেখানে মির্চার শুধু নাভি থেকে হাঁটু পর্যন্ত হালকা সবুজ রঙের সূতি কাপড়ের পায়জামায় ঢাকা। মির্চা এই পাজামা পরে খালি গায়ে পৃথিবীর আকাশ বাতাস জমিন প্রদক্ষীণ করেন। পায়ে এক জোড়া চটি পরেন আর শীতে একান্ত বাধ্য হলে গায়ে একটা চাদর জড়িয়ে নেন।

মির্চার ট্রেডমার্ক পাজামা এতটা সফল হয় যে পৃথিবীর মানুষ বিশ্বাস করেন ঈশ্বর স্বয়ং পৃথিবীতে এক অবতার পাঠিয়েছেন তাঁর সৃষ্টির দরিদ্রতম একটি রাষ্ট্রকে ধনী বানানোর জন্য। মির্চা বলেন তিনি শুধু তাঁর দেশের দারিদ্র্যই দূর করবেন না, বরং সারা পৃথিবীর দারিদ্র্য তিনি দূর করবেন। মির্চার প্রশস্ত হাসির জন্য সকলেই তাঁকে বিশ্বাস করলেন। সমকালীন পৃথিবীর সকল রাষ্ট্রনায়ক, দাতব্য রানী, অকৃত্রিম জনহৈতষী, ধূর্ত মহাজন মির্চার ব্যক্তিগত বন্ধু হওয়ার জন্য লাইনে দাঁড়ান। দেশের রাষ্ট্রপতি মির্চাকে ফোন করলে মির্চার সেক্রেটারি এক এক বার এক এক উত্তর দেন।

‘মির্চা টেলিফোনে আছেন, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর সাথে।’

‘মির্চা টেলিফোনে আছেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সাথে।’

‘মির্চা এখন প্রধানমন্ত্রী রোমানো প্রদির সাথে তাঁর বোলোনিয়ার বাড়িতে খানা খাচ্ছেন।’

‘মির্চা এখন পাল্মা দি মাইয়রকাতে স্পেনের রানীর সাথে সমকামীদের অধিকার সংক্রান্ত একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারে যৌথভাবে সভাপতিত্ব করছেন। ’

‘মির্চা এখন সিনেটর মেককেইনের সাথে আরিজোনা অঙ্গরাজ্যে একটি ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্প উদ্বোধন করছেন।’

‘মির্চা এখন ইন্ডিয়ানা অঙ্গরাজ্যের নটর ডেম স্টেডিয়ামে আইভি লিগ স্টুডেন্টদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা করছেন।’

‘মির্চা এখন গ্রেট ব্রিটেনের মহামহিম রানী থেকে নাইটহুড গ্রহণ করছেন।’

‘মির্চা এখন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টকে সাথে নিয়ে সরবন বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন বসানো মির্চা চেয়ার পরিদর্শন করছেন।’

‘মির্চা এখন হোয়াইট হাউজে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট থেকে মেডাল অব ফ্রিডম গ্রহণ করছেন।’

‘মির্চা এখন নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদরদপ্তরে দুই শতাধিক রাজা, রানী, সম্রাট, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীর সামনে ৫০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবী থেকে দারিদ্র্যকে জাদুঘরে পাঠানোর বিষয়ে তাঁর স্বপ্নের পরিকল্পনা তুলে ধরছেন।’

মির্চার কূটনৈতিক দক্ষতা এতটাই ছিল যে পৃথিবীর ধনী দেশগুলোর জনগণ ভাবতে শুরু করেন তাঁদের প্রপিতামহগণ নন, মির্চাই তাঁদের দেশে সমৃদ্ধি এনেছেন। যদি আপনি তখন টোকিওর রাস্তায় কোনও বালককে জিজ্ঞেস করতেন, ‘বালক, কে তোমার দেশকে ধনী বানিয়েছে?’ বালক উত্তর করত, ‘মির্চা, শুধুই মির্চা।’ যদি আপনি জিজ্ঞেস করতেন, ‘বালক, তুমি কী করে তা জানো?’ বালক দ্বিধাহীন কণ্ঠে উত্তর করত, ‘আমি টেলিভিশনে মির্চাকে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সাথে বিষয়টা নিয়ে আলাপ করতে দেখেছি।’

সারা বিশ্বের দাতব্য প্রতিষ্ঠানগুলি মির্চার ব্যাংককে দানের অর্থে ভাসিয়ে দিতে থাকে। মির্চা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধনীতে পরিণত হন কিন্তু তিনি মানুষকে বিশ্বাস করান ওই সম্পদ তাঁর নয়, তাঁর ঋণগ্রহীতাদের। ‘ঋণগ্রহীতারা এই ব্যাংকের মালিক,’ মির্চার বাণী সারা বিশ্বের সকল গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়।



মির্চা তাঁর এক বেলজিয়ান এটর্নি বন্ধু থেকে প্রাপ্ত তথ্য কাজে লাগান। তথ্যটা এই যে ইউরোপে একটা আইন আছে যদি কেউ কারও জিনিসপত্র সহায়সম্পত্তি তাঁর পেছনে বা তাঁর অজান্তে তিন বার নিজের বলে দাবি করতে সক্ষম হন তবে তিনি সেই জিনিস বা সম্পদের বৈধ মালিক হবেন। মির্চা যখন তাঁর বন্ধুর মোটরগাড়িতে চড়ে ক্ষুদ্র মহাদেশটা ঘুরতে বের হন তখন দেখেন সেখানে মানুষ সকল স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তিতে নিজের নাম লিখে রাখেন। ইউরোপের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য না দেখে মির্চা সাইনবোর্ডগুলি পড়তে থাকেন আর তাদের আকার, আকৃতি, ওজন ইত্যাদি সম্পর্কে ধারণা অর্জন করেন। মির্চা রোমে একটা সাইনবোর্ডে পড়েন ভিলা আদা, তলেদোয় একটা সাইনবোর্ডে পড়েন আভেজ দি কোরাল দি ফিদেল, তুলুজে একটা সাইনবোর্ডে পড়েন লা বিসিক্লিতে দে অম্ব্রে, লিপজিগের পথে এক সাইনবোর্ডে পড়েন হেন্ডরিক্স বমলসপিনেরে, ওয়টারলুতে এক গোলালু ক্ষেতের সাইনবোর্ডে পড়েন লা ফের্মে দে গুইলামে, আমস্টার্ডমে এক গাড়ির সাইনবোর্ডে পড়েন ফেরারি ভন জসুয়া। তিনি সবগুলি সাইনবোর্ড মুখস্ত করেন যদিও তিনি বেশির ভাগ কথার অর্থ বুঝতে পারেননি।

দেশে ফিরে মির্চা তাঁর ট্রেডমার্ক পাজামা বদলানোর আগেই জিনিসপত্রে সাইনবোর্ড টাঙানো শুরু করেন। তিনি লেখেন তারার গরু, দোনার ছাগল, নেহার পান, বানুর সুপারি, রোচেয়ার মিষ্টিকুমড়া, মানার তরমুজ, জুনুর হাস, কুনুর মুরগির ডিম, ছনার পুুঁইশাক, রেজিয়ার কচুর লতি, ছমিরের মাছের পুকুর, নমিরের মাছের জাল। পরের দিন তিনি সেই নারীর নামে তাঁর ব্যাংকের নামকরণ করেন যাঁকে তিনি প্রথম ঋণ দিয়েছিলেন: আঙ্কুরার ব্যাংক। পনেরো দিনের মধ্যে তিনি সারা পৃথিবীর সমগ্র রাজা, রানী, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, জনহিতৈষীকে আমন্ত্রণ করে এনে সাইনবোর্ডগুলি দেখান আর প্রমাণ করেন তাঁর সকল অর্জনের মালিক তাঁর ঋণগ্রহীতারা। রাষ্ট্রনায়করা প্রত্যেকে মির্চাকে সাথে নিয়ে এক একটা সাইনবোর্ডের পাশে ছবি তোলেন। রাজা রানীদের দেহে সাহেবী পোশাক, মির্চার জঙ্ঘায় তাঁর ট্রেডমার্ক পাজাম, গায়ে কৃষকের ঘাম আর মুখে প্রশস্ত হাসি। তাঁরা সকলে মির্চাকে পৃথিবীর সেরা পুরষ্কারে ভূষিত করার জন্য দাবি জানান।

মির্চা ইতিমধ্যে পৃথিবীর সকল নামী ও সকল অখ্যাত পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছেন। যে পুরস্কার যত বেশি অখ্যাত সে পুরস্কার গ্রহণের সময় মির্চা তত বড় প্রশস্ত হাসি হেসেছেন আর পৃথিবী সেই হাসি সমস্ত খবরের কাগজে দেখেছে । এভাবে অনেক পুরস্কার ও অনেক সংবাদপত্রও মির্চার প্রশস্ত হাসির কল্যাণে পরবর্তীতে বিখ্যাত হয়ে গেছে।

এক শীতল আর মেঘাচ্ছন্ন অসলো বিকালে ষাটোর্ধ্ব মির্চা যখন জীবনের প্রশস্ততম হাসিটি হেসে পৃথিবীর সর্বসেরা পুরস্কারটি গ্রহণ করেন তখন তাঁর ঋণগ্রহীতারা কোমর ভাঙ্গা খাটুনি খেটে চলেছেন যাতে তাঁরা ২৫০% সুদসহ ঋণের পরবর্তী কিস্তি পরিশোধ করতে পারেন। ওইসব ঋণগ্রহীতা আমৃত্যু শুধু একটা কথাই ভেবে গেছেন: কেন মির্চার পাওয়া সেই পুরস্কার কৃতদাস পালনের নামে না হয়ে শান্তির নামে হল?


লেখক : সাহিত্যিক, প্রাণ-বাদী,কূটনীতিবিদ 

Comments are closed.

More News Of This Category