সম্প্রতি অনুসন্ধান বন্ধ করে রহিমের অভিযোগগুলো নথিজাত করেছে দুদক। ফলে দুদকের ভৃমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
ফলে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ২২ জানুয়ারি রহিমের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন। তবে তা এখনও কার্যকর হয়নি। কিছুদিন আগে রহিমকে খাদ্য গুদাম থেকে সরিয়ে রাজশাহী জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের দফতরে সংযুক্ত করে রেশন মনিটরিংয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রহিমের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ব্যক্তি ও সহকর্মীদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৬ সালে তদন্ত কমিটি করে খাদ্য অধিদফতর। মোট সাতটির মধ্যে অধিকাংশ অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ২০১৭ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর খাদ্য মহাপরিচালক রহিমের বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন।
বিভাগীয় ব্যবস্থা হিসেবে রহিমের তিন বছরের ইনক্রিমেন্ট কর্তনসহ তাকে রাজশাহী থেকে বরিশাল আঞ্চলিক অফিসে বদলি করা হয়। কিন্তু রহিম সেই নির্দেশ না মেনে ডিজির আদেশের বিরুদ্ধে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর আপিল করেন। পাশাপাশি তার বদলির আদেশের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে রিট করেন। ফলে ২০১৮ সালের প্রথমদিকে রহিম আবারও তার পূর্বের কর্মস্থল সদর খাদ্য গুদামের ওসি-এলএসডি পদে ফিরে আসেন। এর কিছুদিন পর রহিমকে আবারও বদলি করে খুলনা আঞ্চলিক অফিসে সংযুক্ত করা হয়। তবে এবারও রহিম বদলিকৃত কর্মস্থলে যোগ না দিয়ে আবারও উচ্চ আদালতে গিয়ে তার বদলির আদেশ রহিত করেন।
অন্যদিকে খাদ্য মন্ত্রণালয় রহিমের আপিলের পরিপ্রেক্ষিতে আবারও তদন্ত করে। কিন্তু এবারের তদন্তে রহিমের বিরুদ্ধে আগের অধিকাংশ অভিযোগই প্রমাণিত হয়। ফলে রহিমের আপিল খারিজ করে দিয়ে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব শাহাবুদ্দিন আহমেদ ২২ জানুয়ারি এক চিঠিতে তার বিরুদ্ধে পূর্বে ডিজির সুপারিশকৃত বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা বহাল রেখে তা দ্রæত কার্যকরের নির্দেশ দেন। খাদ্য সচিবের চিঠিটি ২৮ ফেব্রæয়ারি রাজশাহী জেলা ও আঞ্চলিক খাদ্য কর্মকর্তার দফতরে পৌঁছায়। তবে খাদ্য সচিবের নির্দেশটি এখনও কার্যকর হয়নি। রহিমের যত সম্পদ অভিযোগের সূত্র অনুসন্ধান করে জানা গেছে, ১৯৯১ সালে সহকারী খাদ্য পরিদর্শক পদে চাকরিতে যোগ দেন আবদুর রহিম। বাড়ি পাবনার ঈশ্বরদীতে। এরপর থেকে তিন দশক ঘুরেফিরে রাজশাহী, নওগাঁসহ আশপাশের এলাকার খাদ্য অফিসসহ খাদ্যগুদামে একটানা কর্মরত থেকেছেন।
এই তিন দশকে তাকে একাধিকবার রাজশাহী অঞ্চলের বাইরে বদলি করা হলেও নানা প্রভাব খাটিয়ে ও কৌশল করে সে তার বদলি বাতিল করে রাজশাহীতেই রয়ে গেছেন।
অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা হলেও খাদ্য গুদামে ধান, চাল, গম ক্রয়ে সিন্ডিকেট করে বিপুল দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে তিন দশকে রহিম কামিয়েছেন বিপুল অবৈধ সম্পদ। দুদক ও খাদ্য বিভাগে করা বিভিন্নজনের অভিযোগ থেকে আরও জানা গেছে, রহিম চুক্তিবদ্ধ মিলারদের সঙ্গে সিন্ডিকেট করে নিজেই ব্যবসায়ী সেজে জেলা ও জেলার বাইরের বিভিন্ন সরকারি গুদামে ধান, চাল, গম সরবরাহ করে বিপুল অর্থ কামাইয়ের অভিযোগ রয়েছে।
এ ছাড়া বিএনপি ও বর্তমান সরকারের আমলে খাদ্য বিভাগের একচেটিয়া নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্য করে রহিম কামিয়েছেন বিপুল পরিমাণ টাকা। বিভিন্নজনের কাছ থেকে ব্যবসার উদ্দেশ্যে প্রচুর টাকা নিয়ে সেসব টাকাও আর সে ফেরত দেননি। অভিযোগ রয়েছে খাদ্য বিভাগের কতিপয় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার রহস্যজনক প্রশ্রয়েই রহিম খাদ্য বিভাগে দুর্নীতির বরপুত্র হয়ে উঠেছেন।
অভিযোগ থেকে জানা গেছে, রহিম নগরীর প্রাণকেন্দ্র সিরোইল বাস টার্মিনাল এলাকায় আরডিএর গোধুলী মার্কেটের তিনতলায় গড়ে তুলেছেন ২২ হাজার বর্গফুটের বিলাসবহুল হোটেল আনজুম ইন্টান্যাশনাল। সব মিলে হোটেলটির মূল্য প্রায় সাড়ে ৫ কোটি টাকা।
ঢাকা বাস টার্মিনালের হানিফ কাউন্টারের ওপর গড়ে তুলেছেন আনজুম ফ্যাশন। একই এলাকায় রয়েছে রহিমের আনজুম নামের একটি চাইনিজ রেস্টুরেন্টও।
শিরোইল মোল্লা মিলের দুই নম্বর গলিতে রয়েছে তিন কাঠা জমির ওপর রহিমের একটি বাড়ি যেখানে রহিম পরিবার নিয়ে থাকেন। এই গলিতে রয়েছে রহিমের আড়াই কাঠা আয়তনের আরেকটি প্লট।
অন্যদিকে, রাজশাহী রেশম কারখানার পূর্ব পার্শ্বে রয়েছে রহিমের ৬ কাঠার কোটি টাকা মূল্যের একটি প্লট। সম্প্রতি নগরীর ভাটাপাড়া এলাকায় একটি বিশাল আয়তনের পুকুর ভরাট করে সেটি স্ত্রী আরিফা সুলতানার নামে রেজিস্ট্রি করেছেন তিনি। এই পুকুরটির মূল্য প্রায় কোটি টাকা বলে জানা গেছে।
রাজশাহীতে ফুড রহিম নামে সমধিক পরিচিত এই খাদ্য কর্মকর্তার নওগাঁ শহরের দয়ালের মোড়ে রয়েছে একটি বাড়ি যা বর্তমানে ক্লিনিক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। নীলফামারীর সৈয়দপুরে রয়েছে রহিমের একটি জুট মিল যেখানে বস্তা তৈরি করা হয় এবং এসব বস্তা খাদ্য বিভাগেই সরবরাহ করা হয়।
এ ছাড়া নাটোরের গোপালপুরে শ্বশুরবাড়ি এলাকায় সাত বিঘা জমি ও একটি বাড়ি কিনেছেন রহিম যার মূল্য প্রায় দেড় কোটি টাকার বেশি। জানা গেছে, রহিমের নিজের বাড়ি পাবনার ঈশ্বরদীর লোকোশেড এলাকায় রয়েছে একটি বাড়ি ও বিপুল সম্পদ। অন্যদিকে রাজশাহী মহানগরীর নওগাদপাড়ায় বাস ও ট্রাক টার্মিনাল এলাকায় রয়েছে রহিমের ৫০টির বেশি দোকান যার মূল্য কয়েক কোটি টাকা।
এ ছাড়া নগরীর শালবাগানে আটতলা বিশিষ্ট নির্মাণাধীন শালবন সুপার মার্কেটটিও রহিমের স্ত্রী আরিফা সুলতানার নামে রয়েছে। ল²ীপুরে জনৈক গোলামের চার কাঠা জমির ওপর একটি বাড়ি দখল করে নিয়েছেন রহিম। এ নিয়ে আদালতে মামলাও চলছে। গোলামকে ব্যবসার অংশীদার করার কথা বলে রহিম ৮২ লাখ টাকা নিলেও তার সঙ্গে প্রতারণা করেন বলে গোলাম অভিযোগে জানিয়েছেন।
খোঁজ নিয়ে আরও জানা যায়, ২০১৬ সালের অক্টোবরে রহিমের অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। দুই বছরের বেশি সময় অনুসন্ধান শেষে সম্প্রতি রহিমের অভিযোগের ফাইল নথিজাত করা হয়েছে। এই নিয়ে খোদ খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তা কর্মচারীদের মাঝে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে।
রাজশাহী অঞ্চল দুদকের উপ-পরিচালক বেনজীর আহমেদ বলেন, তিনি সম্প্রতি রাজশাহীতে যোগদান করেছেন। তবে তিনি আসার আগে রহিমের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অনুসন্ধান কাজটি বন্ধ করা হয়েছে। কার নির্দেশে এবং কেন অনুসন্ধান বন্ধ হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলতে অস্বীকার করেন।
অভিযোগের ব্যাপারে আবদুর রহিম সোমবার বলেন, আমার নিজের নামে কোনো সম্পদ নেই। আমার স্ত্রী তার বাবার কাছ থেকে সব সম্পদ পেয়েছেন। এসব সম্পদ দিয়েই রাজশাহী নগরীতে ব্যবসা ও বাড়িসহ বিভিন্ন সম্পত্তি করেছেন।
শাস্তিমূলক বদলি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, একটি মহল আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। তারা আমার সুনাম ক্ষুণ করার চেষ্টা করছে। উল্লেখ্য, রহিমের স্ত্রী আরিফা সুলতানা একজন গৃহবধূ বলে জানা গেছে।