বিশেষ প্রতিবেদক,চাঁদপুর
চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে নিজের সন্তানদের উদ্ধার করতে থানা পুলিশের সহযোগিতা চেয়ে হয়রানির শিকার হওয়ার ফিরিস্তি লিখে পুলিশ হেডকোয়ার্টারের আইজিপি কমপ্লেইন সেলে একটি অভিযোগ করেন স্বামী পরিত্যক্তা কুয়েত ফেরত নারী হোসনে আরা বেগম (৪০)।
অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে,২৬ বছর যাবত ঐ নারী কুয়েত প্রবাসী ছিলেন। এরই মধ্যে চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জ উপজেলার বড়কূল গ্রামের তারা মিয়া পাটওয়ারী ওরফে আব্দুর রাজ্জাকের ছেলে জাহাঙ্গীরের সাথে তার বিয়ে হয়। তাদের ঘরে ৫টি সন্তান রয়েছে।কিছু দিন পূর্বে তার স্বামী জাহাঙ্গীর কিছু না জানিয়েই তার এক ছেলেকে নিয়ে বাংলাদেশে চলে আসে। পরে তিনিও তার অপর ৪ সন্তানকে নিয়ে দেশে ফিরে আসেন। দেশে আসার পর তার স্বামী তার সঙ্গে প্রতারণার ঘটনা ঘটালে তিনি স্বামীর বিরুদ্ধে আদালতে একটি মামলা করেন। গত ৪ মে তার দুই ছেলে আব্দুল আজিজ (২৩) ও ফাহাদ হোসেন (১৭) তার সৎ ভাই আল আমীন ওরফে রাজুর সাথে একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে যায়। পরে তাদের পিতা জাহাঙ্গীর তাদেরকে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। এ সময় সে জানায় সন্তানদের নিতে হলে নগদ দুই লাখ টাকা দিতে হবে। সন্তানদের তার পিতার কাছ থেকে উদ্ধার করতে তিনি গত ৫ মে হাজীগঞ্জ থানায় এসে ডিউটি অফিসার এএসআই সুজন কুমারকে বিষয়টি জানালে তিনি অভিযোগ দিতে বলেন। অভিযোগ দেয়ার পর হোসনে আরা বেগম হাজীগঞ্জ থানার ইন্সপেক্টর (তদন্ত) নজরুল ইসলাম এর সাথে কথা বলেন।
হোসনে আরা বেগম অভিযোগে আরও উল্লেখ করেন, আমার অভিযোগ পড়ার পর ইন্সপেক্টর (তদন্ত) নজরুল ইসলামক আমাকে ২০ হাজার টাকা দিতে বলে, ২০ হাজার টাকা দিলেই আমার সন্তানদের তিনি উদ্ধার করে দিবে।এরই প্রেক্ষিতে হোসনে আরা বলেন, এত টাকা কিভাবে দিব বলতেই নজরুল ইসলাম অশ্লীল কথা-বার্তা বলতে থাকেন এবং তার সাথে রাত্রিযাপন করতে বলেন। এতে হোসনে আরা বেগম হতভম্ব হয়ে কান্না শুরু করলে ইন্সপেক্টর (তদন্ত) নজরুল ইসলাম পুনরায় বলেন, তাহলে ২০ হাজার টাকা দিতে হবে। পরে ডিউটি অফিসার এএসআই সুজন তার কাছে ১৫ হাজার টাকা দাবি করিয়া নেয়। এ সময় আলী আশ্রাফ নামের এক ব্যক্তিসহ আরো ৩/৪ জন ব্যক্তি ডিউটি অফিসারের সামনেই তাকে অশ্লীল কথাবার্তা বলেন। পরে নজরুল ইসলাম তার সাথে দুর্ব্যবহার ও গালি-গালাজ করে এবং এসব কথা কাউকে জানাই তাহলে তাকে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করিবে হুমকি প্রদান করেন। পরে তিনি থানা থেকে চলে আসতে বাধ্য হন।
এদিকে ঘটনা খবর জানতে পেরে একই দিন (৫ মে) বিদেশ ফেরত ফেরত নারীর বিরুদ্ধে তাঁরই ছেলে আবদুল আজিজ হাজীগঞ্জ থানায় একটি অভিযোগ করেন।এসডিআর নং ১১৪৭ তারিখ ০৫/০৫/২০২৩ ইং।
অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, অভিযোগকারী মোঃ আব্দুল আজিজ (২৩), পিতা-মোঃ জাহাঙ্গীর পাটওয়ারী, মাতা-হোসনে আরা বেগম, সাং-মধ্য বড়কুল (আমিন বেপারী বাড়ী), থানা-হাজীগঞ্জ, জেলা-চাঁদপুর থানায় হাজির হইয়া এই মর্মে অভিযোগ দায়ের করিতেছি যে, আমি একজন ছাত্র ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ব্যক্তি হই। ১নং সাক্ষী আমার ছোট ভাই, ২নং সাক্ষী আমাদের পিতা ও ৩নং সাক্ষী আমাদের বড় ভাই। সকল সাক্ষীগন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী। বর্ণিত বিবাদী আমাদের মাতা হয়। বর্ণিত বিবাদী জোর জুলুমবাজ, অবাধ্য, অন্যায়-অত্যাচারী ও আইন অমান্যকারী প্রকৃতির লোক। আমাদের মাতা বর্ণিত বিবাদী আমাদের পিতা ২নং সাক্ষীর অবাধ্য হইয়া আমাদের পিতার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ২০১৭ সালের ৩০ এপ্রিল আমাদের পিতাকে তালাক প্রদান করিয়া আমাদের মাতা অন্য বিবাহ করে। আমাদের মাতা বর্ণিত বিবাদীর অন্যত্র বিবাহ হওয়ার পর থেকে আমাদেরকে তাহার নিকট নিয়া যাওয়ার জন্য প্রতিনিয়ত হুমকি ধমকি দেওয়া সহ আমরা যদি কোন প্রকার কথা বার্তা না শুনি তাহলে বর্ণিত বিবাদী আমাদের যেকোন প্রকার ক্ষতি সাধন করিবে বলে হুমকি প্রদান করিয়া আসিতেছে। এমতাবস্থায় অদ্য ঘটনার তারিখ ও সময়ে ঘটনাস্থলে আমাদের বড় ভাই ৩নং সাক্ষীর বিবাহ অনুষ্ঠানের আয়োজন কালে বর্ণিত বিবাদী আমাদের মাতা অসৎ উদ্দেশ্যে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হইয়া তথায় উচ্চস্বরে কথা বার্তা বলাবলি করতঃ আমাদের মানসম্মান ক্ষুন্ন করতঃ আমাকে ও আমার ভাই ১নং সাক্ষীকে নিয়া যাওয়ার পায়তারা করে। আমরা যদি আমাদের মাতার সহিত না যাই তাহলে আমাদের মাতা আমাদের বড় ভাইয়ের বিবাহের পরবর্তী অনুষ্ঠান গুলোতে হামলা করিয়া আমাদের মানসম্মান নষ্ট করিবে নচেৎ আমাদের পিতা সহ আমাদের নামে মিথ্যা মামলা দিয়া হয়রানি করিবে বলে প্রকাশ্যে হুমকি-ধমকি সহ ভয়-ভীতি প্রদর্শন করে। পরবর্তীতে আমি ও আমার ভাই ১নং সাক্ষীসহ ঘটনার বিষয়ে অন্যান্য সাক্ষীগন এবং স্থানীয় গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গদেরকে অবহিত করিয়া থানায় আসিয়া অভিযোগ দায়ের করিতে বিলম্ব হইল।
অপরদিকে হোসনে আরা বেগমের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ এনে দোহার থানার বাস্তা গ্রামের মানিক কবিরাজের পূত্র রিপন (৩৯) নামে এক প্রবাসী বিজ্ঞ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, আমলী আদালতে হোসনে আরা বেগম (৩৮)এর বিরুদ্ধে সিআর মামলা দায়ের করে। মামলা নং-৬১/২০২০ ধারা ৪২০/৪০৬/৪৬৭/ ৪৬৮/৪৭১/৫০৬ পেনাল কোড) মামলা দায়ের করেন।
সিআর মামলাটি বিজ্ঞ আদালত হতে অনুসন্ধান পূর্বক প্রতিবেদন দাখিলের জন্য পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ঢাকা জেলাকে নির্দেশ দিলে মামলাটি পুলিশ পরিদর্শক (নিঃ) জনাব আলী ফরিদ আহমেদ,পিবিআই ঢাকা জেলা কর্তৃক অনুসন্ধান কার্যক্রম সম্পাদন করা হয়।যার পিবিআই হেঃ কোঃ স্মারক নং পিবিআই/মামলা/২০২০/৭৮৮/সিআরও (পূর্ব) তারিখ- ০৬/০৮/২০২০ খ্রিঃ।
পিবিআই কতৃক দালিলিক সাক্ষ্যের পর্যালোচনা ও তদন্ত প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে,কাবিননামা যাচাই করে এবং দালিলিক সাক্ষ্য পর্যালোচনা করে বিবাদী হোসনে আরা বেগম এর বিরুদ্ধে প্রতারণাপূর্বক জাল জাল জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে জাল ও ভূয়া নিকাহনামা সৃজন করে নিকাহনামাকে খাঁটি হিসেবে ব্যবহার করার সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া যায় তদন্তে।
পিবিআই তদন্ত রিপোর্ট সূত্রে আরও জানা গেছে,মামলার বাদী মোঃ রিপন এবং বিবাদী হোসনে আরা বেগম কুয়েতে বসবাস করতেন। কুয়েতে বসবাসকালীন সময়ে দুজনের মধ্যে পরিচয় সুত্রে কথাবার্তা হতো। পরিচয় সুত্রে দুজনের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হয় কিন্তু কিন্তু তাদের মধ্যে বিয়ে হয়নি।এক সময় উভয়ে বাংলাদেশে ফেরত চলে আসে। বাংলাদেশে ফেরত চলে আসার পর বিবাদী হোসনে আরা বেগম এই মামলার বাদী রিপনকে স্বামী বলে দাবী করে বিভিন্ন সময় বাদীকে বিরক্ত করে আসছিল।মামলার বাদী রিপন তাকে প্রত্যাখ্যান করায় বিবাদী রিপনের বিরুদ্ধে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানাধীন পাইনার বাজার কাজী অফিসের একটি নিকাহনামা (যার পৃষ্ঠা নং ৭৫, বালাম নং ৫/এ ২০১৮ সাল বিয়ে রেজিষ্টির তারিখ ২৫ জুলাই ২০১৮) ব্যবহার করে বিজ্ঞ চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত নারায়ণগঞ্জ-এ যৌতুক নিরোধ আইনের ৪ ধারায় একটি সিআর মামলা দায়ের করেন। যার নং ২২৪/২০১৮।বিবাদী হোসনে আরা কর্তৃক রিপনের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত উক্ত মামলাটি রুপগঞ্জ থানা পুলিশ কর্তৃক তদন্তকালে উক্ত নিকাহনামাটি জাল ও ভূয়া বলে প্রমানিত হওয়ায় তদন্তশেষে রুপগঞ্জ থানার এস আই আলী আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করেন। বিজ্ঞ আদালত নথি পর্যালোচনা করেন এবং উক্ত সিআর মামলার বাদিনী হোসনে আরা বেগম পরপর তিনটি ধায্য তারিখে বিজ্ঞ আদালতে হাজির না থাকায় মামলাটি ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮ এর ২৪৭ ধারার বিধান মোতাবেক ২৮ মে ২০১৯ তারিখে বিজ্ঞ চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত,নারায়ণগঞ্জ পিটিশন মামলাটি খারিজ করে দেন।এরপরও মামলার বিবাদী হোসনে আরা বেগম রিপনকে স্বামী দাবি করে পুনরায় একই কাজী অফিসের ঠিকানা ব্যবহার করে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে জাল জালিয়াতির মাধ্যমে (পৃষ্ঠা নং-৮, বালাম নং-৫/এ সন-২০১৮, বিয়ে রেজিস্ট্রি তারিখ ২০ জানুয়ারি ২০২০) নিকাহনামা সৃজন করে রিপনকে স্বামী বলে পরিচয় দিয়ে চল্লিশ লাখ টাকা দাবী করে প্রাণনাশের হুমকি দেয়।তদন্তকালে দুটি কাবিননামার সত্যতা যাচাইকালে জানা যায়, দুটি কাবিননামা জাল ও ভূয়া। কাবিননামার বালাম এর কোন অস্তিত্ব পাইনার বাজার কাজী অফিসে পাওয়া যায়নি বলে প্রতিয়মান হয়।
থানায় কেন অভিযোগ নেয়া হলো না?এমন এক প্রশ্নের জবাবে হাজীগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ মোহাম্মদ জোবাইর সৈয়দ বলেন,ঘটনার সময় আমি ছুটিতে ছিলাম। থানায় অভিযোগ করতে আসা হোসনে আরা বেগমকে থানায় কর্মরত ডিউটি অফিসার,ইন্সপেক্টর তদন্ত সর্বাত্মক সহযোগিতা করার চেষ্টা করেন। পরবর্তীতে অভিযোগ দিতে আসা নারীর কথা মতো তাঁর সৎ ছেলের বিয়ে বন্ধ করে দিতে সম্মত না হওয়ায় একপর্যায়ে থানাতেই উত্তেজিত হয়ে অভিযোগ না দিয়েই থানা থেকে বের হয়ে যান।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইন্সপেক্টর (তদন্ত) নজরুল ইসলাম বলেন,ঘটনার দিন ঐ নারী থানায় অভিযোগ করতে এসেছেন।আমরা অভিযোগ কপি প্রস্তুত করতে ঐ নারীকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছি। পরবর্তীতে ঐ নারী তাঁর দুই সন্তানকে অপহরণের ভুল তথ্য উপস্থাপন করে বড়কুল গ্রামের একটি বিয়ে বাড়িতে বিয়ে বন্ধ করার কথা বলে।অভিযোগের ভিত্তিতে বিষয়টি তদন্ত করে দেখার কথা বলতেই উত্তেজিত হয়ে ঐ নারী আমাদের সাথে দুর্ব্যবহার করে দেখে নেয়ার হুমকি দিয়ে থানায় অভিযোগ না করেই দ্রুত সটকে পড়ে।যদিও কাউকেই অপহরণের কোনো ঘটনা ঘটেনি।
২০১৭ সালে তালাক মিমাংসার পর থেকেই প্রবাসী জাহাঙ্গীর তাঁর ছেলেদের পড়াশোনার ব্যয়ভার নির্বাহ করে আসছেন।ছেলেরা তাদের মা হোসনে আরা বেগমের সাথে যোগাযোগ না করার কারণেই এমন ঘটনা ঘটেছে বলে জানা গেছে। তবে জাহাঙ্গীর আলমের ছেলেদের অপহরণ করার কোনো ঘটনাই ঘটেনি। নারী বর্তমানে জাহাঙ্গীরের ছেলেদের মেরে কিংবা ইয়াবা দিয়ে ফাঁসিয়ে দিয়ে সম্মানহানীর অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে বলে জানা গেছে।বিগত সময়ে প্রতারণার মামলায় দুই মাস জেল খেটেছেন ঐ নারী এখন আবার আমাদের মামলা হামলার হুমকিও দিচ্ছেন বলে অভিযোগ করেন প্রবাসী জাহাঙ্গীর।এমনকি মিথ্যা মামলা দিয়ে জাহাঙ্গীরের আত্মীয় স্বজনদের ফাঁসিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করছেন বলে জানিয়েছেন জাহাঙ্গীরের স্বজনরা। এ বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে ভুক্তভোগী জাহাঙ্গীর সহ তাঁর পরিবার পুলিশের উর্ধতন কতৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করছেন।