ক্রাইম রিপোর্ট ডেস্ক
ফারমার্স ব্যাংকের (বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক) সাবেক চেয়ারম্যান ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর, তার পরিবার এবং তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে ৭৯টি ব্যাংক হিসাবের তথ্য মিলেছে। এসব হিসাবে জমা ও উত্তোলন মিলে অন্তত ৪২৫ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে ১৭টি হিসাবে অস্বাভাবিক লেনদেন হয়েছে, যার পরিমাণ প্রায় ৪শ কোটি টাকা। ফারমার্স ব্যাংকের তৎকালীন অডিট কমিটির চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক ওরফে বাবুল চিশতির হিসাব থেকেও তার হিসাবে বিপুল অঙ্কের অর্থ জমা হয়েছে।
পরে মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে এসব অর্থ দিয়ে তিনি ও তার স্ত্রীর নামে অন্তত ছয়টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়েছেন। বর্তমানে তাদের হিসাবগুলোতে মাত্র ৬ কোটি ২৮ লাখ টাকার স্থিতি রয়েছে। বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) তদন্ত প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
ক্ষমতার অপব্যবহার, অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে মখা আলমগীর এসব অর্থ উপার্জন করেছেন বলে সন্দেহ বিএফআইইউর। তার আয়কর নথিতে এসব অর্থ প্রদর্শন করা হয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখার জন্য প্রতিবেদনটি সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাছে পাঠানো হয়েছে। সেই সঙ্গে এটি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) কাছেও পাঠানো হয়। এতে তার মানিলন্ডারিং সংক্রান্ত লেনদেনগুলোর বিষয়ে অধিকতর অনুসন্ধান ও তদন্তের সুপারিশ করা হয়েছে।
বাজেয়াপ্ত করে আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন অনেকে।
পদ্মা ব্যাংকে বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শওকত আলী খান। মখা আলমগীরের শেয়ারের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি আমাদের সময়কে বলেন, তার কি পরিমাণ শেয়ার আছে সেটি নির্দিষ্ট করে বলতে পারছি না। পরবর্তী পর্ষদসভার আগেই খোঁজ নেব। সেই সঙ্গে বিগত সময়ের ঋণ অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে সাবেক পরিচালকদের সম্পৃক্ততা রয়েছে কিনা, সেটি অভ্যন্তরীণ তদন্তের মাধ্যমে খতিয়ে দেখব।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ফারমার্স ব্যাংকের প্রায় ১৬০ কোটি টাকা আত্মসাতের মাধ্যমে পাচারের অভিযোগে বাবুল চিশতি ও তার ছেলে রাশেদুল হক চিশতিকে ১২ বছর কারাদ- দেওয়া হয়। তারা এখন জেলে। আর মখা আলমগীর বর্তমানে পরিবারসহ আমেরিকায় অবস্থান করছেন। তার বক্তব্য জানতে নানাভাবে চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। এদিকে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর গত বছরের অক্টোবরে ফারমার্স ব্যাংকের জামালপুরের বকশীগঞ্জ শাখা থেকে সন্দেহজনক লেনদেনের মাধ্যমে ৮ কোটি ৮৬ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে তিনিসহ সাতজনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক।
কার নামে কত হিসাব ও লেনদেন : মখা আলমগীরের নিজ নামে ২১টি ব্যাংক হিসাব রয়েছে। এর মধ্যে সঞ্চয়ী ১৩টি, স্থায়ী ৫ ও চলতি হিসাব ৩টি। এসব হিসাবে লেনদেন হয়েছে প্রায় ১৩৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে জমাসংক্রান্ত ৭৭ কোটি ৭৬ লাখ ৪৬ হাজার এবং উত্তোলনসংক্রান্ত ৬৭ কোটি ৭৫ লাখ ৪ হাজার টাকা। স্ত্রী সিতারা আলমগীরের নামে ২৯টি ব্যাংক হিসাব রয়েছে। এর মধ্যে সঞ্চয়ী ৪টি, স্থায়ী ২৮টি ও চলতি হিসাব ১টি। তার হিসাবগুলোতে লেনদেন হয়েছে প্রায় ১৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে জমাসংক্রান্ত ১২ কোটি ৩৩ লাখ এবং উত্তোলনসংক্রান্ত ৫ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। মখা আলমগীর ও তার স্ত্রীর মালিকানাধীন ব্যবসার নামে ২৯টি ব্যাংক হিসাব রয়েছে। এর মধ্যে সঞ্চয়ী ৪টি, স্থায়ী ২৪টি ও চলতি ১টি। হিসাবগুলোতে প্রায় ১৭২ কোটি টাকার লেনদেন হয়। এর মধ্যে জমাসংক্রান্ত ১৩৫ কোটি ৯২ লাখ ২৩ হাজার এবং উত্তোলনসংক্রান্ত ১৩৫ কোটি ৮৯ লাখ ৬৫ হাজার টাকা। ইতোমধ্যে বিএফআইইউ কর্তৃক তাদের ৩৩টি হিসাব স্থগিত করা হয়েছে, যাতে মোট ৬ কোটি ২৮ লাখ টাকার স্থিতি রয়েছে। এর মধ্যে মখা আলমগীরের হিসাবে স্থিতি রয়েছে মাত্র ১ লাখ ৪৬ হাজার টাকা।
চলতি হিসাবে যত সন্দেজনক লেনদেন : মখা আলমগীরের নামে যমুনা ব্যাংকের গুলশান শাখায় একটি চলতি হিসাব রয়েছে, যার নং ১০০১০০০১২১৬৩৩। এই হিসাবে মাহবুবুল হক চিশতির যমুনা ব্যাংকের হিসাব থেকে ২০১১ সালের ২৩, ২৬, ২৭ ও ২৮ জুনে ৪টি চেক ট্রান্সফারের মাধ্যমে ৮ কোটি টাকা জমা হয়। একই শাখায় পরিচালিত রাশেদ এন্টারপ্রাইজের হিসাব হতে ওই বছরের ২৭ জুনে ২.২০ কোটি ও বকশিগঞ্জ জুট স্পিনার্সের হিসাব হতে ১.৩০ কোটি টাকা জমা হয়। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দুটির ব্যাংক হিসাবের কেওয়াইসির তথ্য বলছে, রাশেদ এন্টারপ্রাইজের মালিক মাহবুবুল হক চিশতি এবং বকশিগঞ্জ জুট স্পিনার্সের মালিক মাহবুবুল হক চিশতির পুত্র রাশেদুল হক চিশতি। এ ছাড়া ব্যাংক এশিয়ার গুলশান শাখা হতে ৮০ লাখ ও প্রাইম ব্যাংকের মতিঝিল শাখা হতে ১ কোটি টাকা জমা হয়। এর বাইরে হিসাবটিতে ২০১১ সালে ১৪ ডিসেম্বর ৫০ লাখ এবং ২০১২ সালোর ২৮ জুন ২.৫০ কোটি টাকা নগদে জমা হয়।
অন্যদিকে মাহবুবুল হক চিশতির হিসাবে নগদ ও ট্রান্সফারের মাধ্যমে ২০১১ সালের ১২ জুন হতে ২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রায় ৫০ কোটি টাকা জমা এবং সমপরিমাণ অর্থ উত্তোলিত হয়। একইভাবে বকশিগঞ্জ জুট স্পিনার্সের হিসাবে ৭৫ কোটি টাকা জমা, রাশেদ এন্টারপ্রাইজের হিসাবে ৫০ কোটি জমা করে সন্দেহজনকভাবে লেনদেন করা হয়। এসব হিসাবে জমাকৃত অর্থ হতে যমুনা ব্যাংক গুলশান শাখায় মোহাম্মদ গোলাম রসুলের নামে পরিচালিত হিসাবে ৬ কোটি, রাশেদুল হক চিশতির নামে একই ব্যাংক শাখায় পরিচালিত হিসাবে ২.৭০ লাখ, মখা আলমগীরের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গুলবাহার হিমাগার নামীয় ব্যাংক হিসাবে (সিটি ব্যাংক, গুলশান অ্যাভিনিউ শাখা) ৫০ লাখ টাকা স্থানান্তর করা হয়। একইভাবে মখা আলমগীরের হিসাবটি হতে মাহাবুবুল হক চিশতি ও রাশেদুল হক চিশতি কতৃক ৯.৮০ কোটি টাকা নগদ উত্তোলন করা হয়। গোলাম রসুল নামীয় ব্যাংক হিসাবের কেওয়াইসি অনুযায়ী হিসাবটির নমিনি রাশেদুল হক চিশতি এবং জমাকৃত অর্থ একই দিনে ১.৫০ কোটি টাকা নগদ উত্তোলন এবং ৪.৫০ কোটি টাকা রাশেদুল হক চিশতির মালিকানাধীন বকশিগঞ্জ জুট স্পিনার্সের হিসাবে স্থানান্তর করা হয়। এ ছাড়া মোহাম্মদ গোলাম রসুলের হিসাবটিতে মাত্র অল্প সময়ের ব্যবধানে ১৫ কোটি টাকা জমা করে একই সময়ে উত্তোলন করা হয়।
নিয়ম অনুযায়ী হিসাবটির নমিনি রাশেদুল হক চিশতি এবং জমাকৃত অর্থ একই দিনে ১.৫০ কোটি টাকা নগদ উত্তোলন এবং ৪.৫০ কোটি টাকা রাশেদুল হক চিশতির মালিকানাধীন বকশিগঞ্জ জুট স্পিনার্সের হিসাবে স্থানান্তর করা হয়। এ ছাড়া মোহাম্মদ গোলাম রসুলের হিসাবটিতে মাত্র অল্প সময়ের ব্যবধানে ১৫ কোটি টাকা জমা করে একই সময়ে উত্তোলন করা হয়।
নিয়মানুযায়ী ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিএফআইইউর কাছে সন্দেহজনক লেনদেন প্রতিবেদন (এসটিআর) ও সন্দেহজনক কার্যক্রম প্রতিবেদন (এসএআর) পাঠাতে হয়। একইভাবে ১০ লাখ টাকার ওপরে যে কোনো ধরনের লেনদেন হলে তা নগদ লেনদেন প্রতিবেদন (সিটিআর) হিসেবে রিপোর্ট করতে হয়। কিন্তু তখন ব্যাংকগুলো থেকে এসব লেনদেনের কোনো রিপোর্ট করা হয়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপত্র মো. আরিফ হোসেন খান বলেন, কোনো হিসাবে সন্দেহজনক লেনদেন (এসটিআর) হলে সেটা সংশ্লিষ্ট ব্যাংক থেকে রিপোর্ট না করা পর্যন্ত বিএফআইইউ বা বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে জানা সম্ভব না। এ কারণেই সন্দেহজনক লেনদেন রিপোর্টিংয়ের নিয়ম চালু করা হয় এবং তা পরিপালনে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া আছে। তবে কি কারণে ব্যাংকগুলো তখন রিপোর্ট করেনি, তার জবাব তারাই দিতে পারবে।
দুর্নীতির টাকায় ছয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান : ব্যাংক হিসাবের তথ্য যাচাই ও তদন্তকালে মখা আলমগীর পরিবারের ছয়টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের খোঁজ পেয়েছে বিএফআইইউ। এগুলো হলো- শুভ অটো রাইস মিল, সুলতানা ফিলিং স্টেশন, মেসার্স সুলতানা ওয়েল মিল, গুলবাহার হিমাগার লিমিটেড ও সুলতানা ফাউন্ডেশন। এসব প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব ব্যবহার করে ৩২.৯১ কোটি টাকা নগদ জমা এবং ১৯.৬১ কোটি টাকা নগদ উত্তোলন করা হয়। নগদে জমা ও উত্তোলনের ভাউচারের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, চাঁদপুর কচুয়া ব্যাংক শাখার পাশাপাশি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ ঢাকার বনানী ও গুলশান ব্যাংক শাখায় লেনদেন করা হয়েছে।
বিএফআইইউ বলছে, আলোচ্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো চাঁদপুরে অবস্থিত হলেও নগদ অর্থ জমা ও উত্তোলনের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ লেনদেন ঢাকার গুলশান ও বনানীতে সংঘটিত হয়েছে, যা সন্দেহজনক। কারণ প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসার প্রকৃতি, ধরন ও উদ্দেশ্যের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ। নগদ অর্থ লেনদেন ছাড়াও হিসাবগুলো হতে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে অসংখ্য লেনদেনের মাধ্যমে অর্থ স্থানান্তর করা হয়েছে, যার প্রকৃত উদ্দেশ্য চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি।
স্ত্রী ও তার অন্যান্য হিসাবে অস্বাভাবিক লেনদেন : মহিউদ্দিন খান আলমগীর ও তার স্ত্রীর ব্যক্তিগত নামে পরিচালিত হিসাবগুলোতে নগদে ৬.৭২ কোটি জমা এবং ১৩.৩০ কোটি নগদ উত্তোলিত হয়েছে। এসব নগদ অর্থ জমা ও উত্তোলনের ক্ষেত্রে মো. মাহেদুল আলম খান, মোস্তফা কামাল, শামীম, মাসুদুল ইসলাম, আনান আশেক আরিফিন, মো. হাসান মজুমদার, মো. শাহজাহান, মো. রুবেল, শরীফ মো. কামাল হোসেন, মীর আল আমিন ও মো. আহাদ হোসেনের নাম উঠে এসেছে তদন্ত প্রতিবেদনে। (সূত্রঃ আমাদের সময়)