সোমবার, ২০শে মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৬ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মৃত্যুঞ্জয়ী জাতীয় চার নেতা

মোহাম্মদ বেলাল হোসেন


 মনীষীরা বলেছেন, ‘ইতিহাসে কোনো ফাঁক রাখতে নেই। ফাঁক থাকলেই ঢুকে পড়ে জঞ্জাল। যার যেখানে স্থান নেই, সে সেখানে তখন স্থান দখল করে নেয়’। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে স্বাধীনতার প্রতিপক্ষ, দ্বিধা-বিভক্তকারী ও সুযোগসন্ধানীরা এই অপচেষ্টা বার বার করেছে। কিন্তু ইতিহাসের সত্যকে কখনোই মুছে ফেলে যায়না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের গৌরবজ্জ্বল অধ্যায় হল ১৯৭১ সালের নয়টি মাস। ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ যখন বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করেছিল পাকবাহিনী, সেই সময়ে মুক্তিপাগল দিশেহারা একটি জাতিকে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে এসেছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগ এর চার শীর্ষ নেতা। যারা আমাদের কাছে জাতীয় চারনেতা নামে পরিচিত। এই চার মহান নেতার নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরে গঠিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার। মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয় মাস আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়, মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং, শরণার্থী পুনর্বাসন এবং স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশ পুনর্গঠনে জাতীয় চারনেতার ভূমিকা ছিল অতুলনীয়। খাঁটি নেতা তারাই যারা অন্যের বেদনার ভার নিজ কাধে বহন করার সাহস রাখেন। মুক্তির পিচ্ছিল পথটির পথপ্রদর্শক হন। প্রজ্ঞা সততা, সাহস ও দক্ষতার আলো ছড়িয়ে দেন সমাজের মাঝে। এই বিরল গুনাবলীতে সমাদৃত ছিলেন আমাদের জাতীয় চারনেতা। যাদের কথা নতুন প্রজন্ম না জানলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে।


জেল হত্যা দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি


জাতীয় চার নেতার অন্যতম ছিলেন তাজউদ্দিন আহমদ। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে দূরদর্শিতা ও সাংগঠনিক দক্ষতা দিয়ে তিনি বাঙালির মুক্তিসংগ্রামকে এগিয়ে নিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ পাকবাহিনীর চোখ এড়িয়ে দুর্গম যাত্রার সঙ্গী ব্যারিস্টার আমির-উল-ইসলাম এর সঙ্গে ঢাকা ত্যাগ করার সময় রাস্তা থেকে কুড়িয়ে পাওয়া একটি কাগজে তাঁর স্ত্রীকে লিখেছিলেন, “লিলি আমি চলে গেলাম, যাবার সময় কিছুই বলে আসতে পারিনি। মাফ করে দিও। আবার কবে দেখা হবে জানিনা। তুমি ছেলেমেয়ে নিয়ে সাড়ে সাতকোটি মানুষের সাথে মিশে যেও”। এভাবে পরিবার ছেড়ে মুক্তিসংগ্রামের অনিশ্চিত যাত্রায় তিনি পা বাড়িয়েছিলেন। ৩০ মার্চ তাজউদ্দীন আহমদ ভারতের বিএসএফ এর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান জেনারেল গোলক মজুমাদারের সাথে সাক্ষাত করেন। ক্লান্ত, শ্রান্ত ও অনাহারে ক্লিষ্ট তাজউদ্দীন আহমদের প্রথম কথাই ছিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সাথে সাক্ষাত। ৩ এপ্রিল তিনি ইন্দিরা গান্ধীর সাথে সাক্ষাত করেন এবং বাংলাদেশের পক্ষে নিঃশর্ত সমর্থন কামনা করেন। এরপর মেহেরপুরের বৈদ্যনাথ তলায় ১৭ এপ্রিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়। বঙ্গবন্ধুর নামে তিনি এই স্থানের নামকরণ করেন মুজিবনগর। জাতির চরম দুঃসময়ে নির্মোহ, নিঃস্বার্থ সাধকের মতোই তাজউদ্দিন আহমেদ হাল ধরেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের একদিকে পাকবাহিনীর আক্রমন, অন্যদিকে খন্দকার মোস্তাক আহমদের পাকিস্তান ও ঈওঅ এর সাথে সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা কঠিন হস্তে তিনি মোকাবেলা করেন।
বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্থ সহচর ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। ১৯৫৭ সালে তিনি বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৬৬ সালে ৬ দফা আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখন আইয়ুব সরকার বঙ্গবন্ধুসহ অসংখ্যা নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করে। সেই সংকটময় মুহূর্তে (১৯৬৬-৬৯) সৈয়দ নজরুল ইসলাম আওয়ামী লীগ এর ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠিত হলে তিনি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধের পুরো ৯ মাস বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে দায়িত্ব পালনে বিশ্বস্থতার সামান্যতম ঘাটতি ছিল না। স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহন করে দেশের শিল্পখাতের অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। বঙ্গবন্ধুর পক্ষ হতে অর্পিত সরকার ও দলের বিভিন্ন দায়িত্ব তিনি বিশ্বস্থতার সাথে পালন করেছেন। আদর্শের প্রশ্নে আপোষহীন ছিলেন তৃণমূল থেকে বেড়ে উঠা এই নিঃস্বার্থ রাজনীতিবিদ।
ইসলামিয়া কলেজে পড়ার সময় বঙ্গবন্ধুর সাথে পরিচয় ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর। সেই থেকে রাজনৈতিক সহকর্মী। ১৯৫১ সালে তিনি আওয়ামী মুসলিম লীগে যোগদেন। দালের পাবনা জেলা কমিটির সভাপতির দায়িত্ব নেন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে তিনি সিরাজগঞ্জের কাজীপুর নির্বাচনী এলাকা থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। প্রাদেশিক মন্ত্রিসভায় খাদ্য, আইন, ও রাজস্ব মন্ত্রনালয়ের দায়িত্ব নেন। ১৯৬৬-৬৭ তিনি পাবনা কারগারে বন্দী ছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ গ্রেফতার হলে, তিনি জীবনের ঝুকি নিয়ে ভারতে গমণ করেন। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন। সফেদ সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবী পরে মনসুর আলী মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস রণাঙ্গনে ছুটে বেরিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশে যোগাযোগ অবকাঠামো গড়ে তোলা, চট্টগ্রাম ও মংলা পোর্ট চালু করার জন্য নিষ্ঠার সাথে কাজ করেছেন। মনসুর আলী ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যার পর প্রতিশোধ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য তীব্রভাবে চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সহকর্মীদের ভীরুতা, সামরিক-বেসামরিক ষড়যন্ত্রের কারণে সফল হননি। খন্দকার মোস্তাকের মন্ত্রিসভায় প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিতে বললে তিনি বলেছিলেন, “তোমার মত বেঈমানের সাথে আমি হাত মেলাবনা, জীবন দেব, তবুও আমি প্রধানমন্ত্রী হবনা”। শহীদ মনসুর আলী আপস করেননি, আত্মসমর্পন করেননি। তিনি বঙ্গবন্ধুর জীবনের সাথী ছিলেন, মরণেও সাথী হয়েছেন।
জাতির পিতার বিশ্বস্থ সহকর্মী আবুল হাসনাত মোহাম্মদ কামরুজ্জামান। তিনি বৃহত্তর রাজশাহীর বনেদি পরিবারের সন্তান ছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের পর শেখ ফজলুল হক মনি, তোফায়েল আহমদ এবং আরও কয়েকজন নেতাকে সাথে নিয়ে বগুড়া হয়ে কলকতা চলে যান। চোখ মুখে ক্লান্তির চাপ, বুকে ছিল অদম্য সাহস। ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ মুজিবনগর সরকারের স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসন দপ্তরের দায়িত্ব নেন। যুদ্ধকালীন সময়ে সীমান্তবর্তী এলাকা সমূহে চষে বেরিয়েছেন। যুদ্ধকালীন দুর্যোগ ও সংকট মোকাবেলায় ত্রাণ সংগ্রহে অতুলনীয় ভূমিকা রাখেন। স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু সরকারের সময়ে (১৯৭২ – ১৯৭৪) বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। অত্যন্ত হাসি খুশি মানুষ ছিলেন কামরুজ্জামান। আভিজাত্য ও রাজনৈতিক উচ্চাসনের অহংকার তাকে কখনো স্পর্শ করেনি। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর কঠিন সময়ে শত্রুর আপোষ প্রস্তাব তিনি ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করেন।
বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত ভ্যানগার্ড ছিল আমাদের প্রিয় জাতীয় চারনেতা। তাদের যেমন ছিল যোগ্যতা, তেমনি ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রতি বিশ্বস্থতা। দেশের সংকটে সংগ্রামে তাঁরা বঙ্গবন্ধুর পাশে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, পরাজয়ের অপমানে পিষ্ট বাঙালি জাতিকে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে স্বপরিবারে হত্যা করার পর গ্রেফতার করা হয় জাতীয় চারনেতাকে। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ১নং সেলে তাজউদ্দিন আহমদ ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ২নং সেলে ছিলেন ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও এএইচএম কামরুজ্জামান। ৩ নভেম্বর ১৯৭৫, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার চত্বরে নিরব থকথকে অন্ধকার। এই রাত সম্পর্কে লে. কর্ণেল এম. এ হামিদ পিত্রসসি (তিনটি অভ্যুথান ও কিছু না বলা কথা) গ্রন্থে লিখেন “৩ নভেম্বর গভীর রাতে রিসালদার মোসলেম উদ্দিন একদল সৈন্য নিয়ে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে ঢুকতে চাইলে জেলার আব্দুল আওয়াল তাদের বাঁধা দেয়। ডিআইজি প্রিজনকে বাসা থেকে ডেকে আনলে রিসালদার মোসলেম উদ্দিন বলল, চারনেতাকে তাঁদের হাতে তুলে দিতে হবে। ডিআইজি বিনয়ের সাথে বলল এটা জেল আইনের পরিপন্থী। অবশেষে বঙ্গভবন থেকে প্রেসিডেন্ট মোশতাকের ফোন আসে। খোদ প্রেসিডেন্টের নির্দেশে ১নং সেলে আনা হয় চারজনকে। তারপর খুব কাছে থেকেই স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দিয়ে গুলি করা হয় চারজনকে। তিন জন সাথে সাথেই নিহত হন। তাজউদ্দীন আহমদ প্রচুর রক্তক্ষরনের পর মারা যান”। পৃষ্টা- ৯৮
১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ছিল, বাঙালির জাতির ইতিহাসে নৃশংস, বর্বর ও কলঙ্কময় কালোরাত্রি। বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করতে অস্ত্রের দমকে থমকে দেওয়া হয় জাতীয় চারনেতার কন্ঠস্বর। কিন্তু ইতিহাসের সত্যকে ক্ষণিকের জন্য চাপা দেওয়া যায়, তবে তা কখনো চিরস্থায়ী হয়না। আজও বাংলার আকাশ বাতাসে কান পাতলে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চারনেতার হৃদস্পন্দন শোনা যায়। তাদের সুমহান আদর্শ মুক্তিকামী মানুষের মনে বিদ্রোহী প্লাবন নিয়ে আসে। আপোষহীন দেশপ্রেম, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি অবিচল রাজনীতিবিদের বিরল দৃষ্টান্ত জাতির প্রিয় চারনেতা। তাইতো ৩ নভেম্বর এলে আমাদের হৃদপিণ্ডে রক্তক্ষরণ হয়, ক্রোধের বহ্নিশিখা জ্বলে উঠে। তবে বাঙালির ইতিহাসের মীরজাফরেরা আজ পরাজিত। জাতীয় চারনেতার আদর্শ ও স্বপ্নের বাংলাদেশ এখন দৃশ্যমান। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে নবপ্রজন্মের কাছে মৃত্যুঞ্জয়ী চিরভাস্বর হয়ে থাকবেন জাতীয় চারনেতা।

লেখক : ইতিহাস বিষয়ক গবেষক

Comments are closed.

More News Of This Category