সোমবার, ২০শে মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৬ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কল্পনা চাকমা কি বেঁচে আছে?

•  কল্পনা চাকমা অপহরণের ২৩ বছর পূর্ণ হলো আজ 


নিউজ ডেস্ক


আজ ১২ জুন জুম্ম জনগণের একটি স্মরণীয় দিন। ১২ জুন পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম নারী জাগরণের অগ্রসেনানী ও পার্বত্য নারী সমাজের বীরাঙ্গনা ও একজন আপোষহীন সংগ্রামী নেত্রী কল্পনা চাকমাকে আমাদের কাছ থেকে হারিয়েছিলাম। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃক বাঘাইছড়ি উপজেলার নিউলাল্যাঘোনা গ্রামের নিজ বাড়ি হতে গভীর রাতে অপহৃত হন কল্পনা চাকমা। অপহরণের পর পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঘাইছড়ি উপজেলায় আপোষহীন নারী নেত্রী, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাংগঠনিক সম্পাদক কল্পনা চাকমার মুক্তির দাবীতে প্রতিবাদী জুম্ম জনগণ ২৭ জুন অর্ধ দিবস অবরোধের ডাক দেয়।

কল্পনা চাকমা ও একটি হিংস্র হায়েনা

কল্পনা চাকমার মুক্তির দাবীতে অবরোধ চলাকালে আপোষহীন ছাত্র সংগঠন পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের সংগ্রামী সহযোদ্ধা রুপম চাকমাকে বাংলাদেশ সরকারের বৈধ সন্ত্রাসীরা অত্যন্ত কাছ থেকে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করে। পরবর্তীতে সংগ্রামী পিসিপির সহযোদ্ধা সুকেশ ও মনতোষদের একইভাবে নরপিশাচরা অত্যন্ত নৃশংসভাবে হত্যা করে। কল্পনা চাকমার মতোই সংগ্রামী সহযোদ্ধা রুপন, সুকেশ ও মনতোষদের লাশের কোন হদিস পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশের বৈধ সন্ত্রাসীর মদদে বহিরাগত সেটেলার বাঙালী লাশগুলো ফেরত দেয়নি। গত ২৩ বছর ধরে পালাক্রমে ৩৯ জন তদন্ত কর্মকর্তা এ মামলার তদন্ত করেছেন। সর্বশেষ রাঙামাটি জেলা পুলিশ সুপার ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে একটি তদন্ত রিপোর্ট জমা দিয়েছে আদালতে। কিন্তু আজ পর্যন্ত জানা যায়নি অপরাধী কারা, কল্পনা চাকমা কোথায় আছে, আদৌ বেঁচে আছে কী না? আসামীদের তো বিচারের আওতায় আনা দূরের কথা, চিহ্নিত পর্যন্ত করতে পারেনি এ রাষ্ট্র! স্বাধীনতার ৪৮ বছরেও এ দেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতি, আইনের শাসনের অভাব এবং পার পেয়ে যাবার সংস্কৃতি অব্যাহত রয়েছে সেটা কল্পনা চাকমা অপহরণ মামলার ঘটনায় স্পষ্ট হয়েছে। সুতরাং পাহাড়ের মানুষ চায় সুস্পষ্টভাবে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হোক, আসামীদের বিচারের কাঠগড়ায় এনে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া হোক; কল্পনা চাকমা কোথায় আছে, কিভাবে আছে, বেঁচে আছে কিনা নেই এসব কিছু তথ্য তদন্তপূর্বক প্রকাশ করা হোক।

বিগত সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের অসংখ্য অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা সংগঠিত হয়েছিল। তার মধ্যে ১৯৯৬ এর ১২ জুনের অপহরণের ঘটনাটি পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসে একটা অন্যতম কালো অধ্যায়ের সৃষ্টি করে। পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের অন্তরের মাঝে তীব্র শিহরণ জাগ্রত করে দেয়। যা কখনও ভুলবার নয়!

আপোষহীন এক জুম্ম নারী নেতৃত্বকে স্মরণ করার একটি দিন হল ১২ জুন। ১২ জুন আসলে পার্বত্য চট্টগ্রামের বুকে অপহৃত আপোষহীন এক নারী নেতৃত্বকে মনে পড়ে যায়।


১২ জুনের তাৎপর্য বুঝতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে নারী তথা মানব সমাজের অতীত ও বর্তমান বাস্তবতা কোন পর্যায়ে ছিল এবং আছে। আমাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, মানবসমাজের ঊষালগ্নে নারীদের অনেক সম্মান ও মর্যাদা ছিল। নারী ও পুরুষের কোন ভেদাভেদ ছিল না। সমাজের মধ্যে সমমর্যাদা ও সমঅধিকার ছিল। কিন্তু সত্য তো এটায় যে, সমাজ বিকাশের এক পর্যায়ে নারী ও পুরুষের ভেদাভেদ উদ্ভব হয়, সমমর্যাদা ও সমঅধিকার খর্ব হয়। মানবসমাজে মানুষের মধ্যে বৈষম্য, নিপীড়ন, শোষণ, মর্যাদাহানি ও চরম অবহেলা চলতে থাকে। মানবসমাজের ক্রমবিকাশের ধারায় বিশেষ করে সামন্ত সমাজের শুরুতে নারীদের সামগ্রিক জীবন অত্যন্ত গন্ধিবদ্ধই ছিল। সে সামন্ত সমাজের মধ্যে কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস প্রচুর পরিমানে বিরাজমান থাকায় এহেন পরিস্থিতিতে নারী সমাজ আতুর ঘর, রান্নাঘর, শোয়ার ঘর হতে বেড়িয়ে আসার মত কোন বাস্তবতা তৈরি করতে পারেনি। সমাজ বিকাশের এক পর্যায়ে সামন্ত সমাজের কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসের বেড়াজালে গন্ধিবদ্ধ নারী সমাজকে কুয়োর ব্যঙের গর্ত হতে বেড়িয়ে আসার বাস্তবতা স্বয়ং সমাজ ব্যবস্থায় সৃষ্টি করে দিয়েছিল। সমাজের মধ্যে ৯০% মানুষ ভাববাদী দর্শনের উপর নির্ভর করে জীবন অতিবাহিত করে। সে ৯০% মানুষই অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারকে তাদের চলমান জীবনের সঙ্গী হিসেবে বেছে নেই। সেজন্য চলমান সমাজ ব্যবস্থায় আজ বৈষম্য, শোষণ, বঞ্চনা ও অবহেলা প্রকট আকার ধারণ করেছে। এখনও সমাজের মানুষের মধ্যে বদ্ধমূল ধারণা হল নারী একটা ভোগ করার বস্তুমাত্র, সন্তান উৎপাদন করাই তার কাজ আর পুঁজিবাদী সমাজে তো একটা পণ্য হিসেবে নারীকে উপস্থাপন করা হয়। নারীকে পণ্য বানিয়ে কোটি কোটি মুনাফা লুটে নেই পুঁজিপতিরা। শুধুমাত্র নারীই নয়, পুঁজিবাদী সমাজে সমস্ত জিনিসকে পণ্য হিসেবে মূল্যায়ন করে। এই ভোগবাদী ও স্বার্থবাদী সমাজের চরম প্রতিক্রিয়াশীল, সুবিধাবাদী ও দোদুল্যমান জীবনধারার চলমান সংস্কৃতি থেকে ১২ জুনের অপহৃত একজন আপোষহীন নারী নেত্রীকে বেড়িয়ে আসতে দেখেছিলাম। কে সেই আপোষহীন নারীনেত্রী? কল্পনা চাকমা ব্যতীত আর তো কেহ নন!

পাহাড়ের জীবনধারা আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। চারিদিকে শোষণ আর বঞ্চনার অপসংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়েছে। অত্যাচারী স্বৈরশাসকের ন্যায় আজ বাংলাদেশ সরকার আমাদের উপর জোরপূর্বক চাপিয়ে দেয়ার সংস্কৃতি চলমান রেখেছে। আমাদের পাহাড়ের জীবনধারা আজ একটা সংকটময় পরিস্থিতির সম্মুখীন। সেই সংকট হতে উত্তরণের পথ দেখিয়ে দিয়েছে ১২ জুনে(নরপিশাচ সেনাসদস্য লেঃ ফেরদৌস কর্তৃক) অপহৃত আপোষহীন নারী নেত্রী কল্পনা চাকমা। জুম পাহাড়ের জুমিয়া নারী, কল্পনার তেজোদৃপ্ত বজ্রকণ্ঠস্বর কি কোনদিন শুনেছিলে, অসমশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করা আদর্শের সুদৃঢ় চেতনা কি কোনদিন গভীরভাবে উপলদ্ধি করেছিলে এবং “একটি স্ফুলিঙ্গ দাবানল সৃষ্টি করে” যার বাস্তব প্রমাণ তো কল্পনা চাকমা স্বয়ং নিজেই। আজ পাহাড়ের বুকে কল্পনা চাকমার মৃত্যু হয়েছে ঠিক, কিন্তু তাঁর চেতনার কোনদিন মৃত্যু হয়নি। পাহাড়ের চূড়ায় ও পার্বত্য চট্টগ্রামের চারিদিকে শাসকশ্রেণির বিরুদ্ধে তাঁর চেতনা লালনকারী অসংখ্য জুম্ম নর-নারী আজ লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। কল্পনা চাকমাকে অপহরণ করা যায়, কিন্তু তাঁর আদর্শ ও চেতনাকে অপহরণ করা যায় না। পাহাড়ের চারিদিক হতে এখনও স্লোগান আসতে থাকে কল্পনা চাকমার অপহরণের যথাযথ বিচার চাই। অপহরণকারী দোষী সেনাসদস্য লেঃ ফেরদৌস এর ফাঁসি চাই। শুধুমাত্র পার্বত্য চট্টগ্রাম নয় বাংলাদেশের প্রগতিশীল শক্তি তথা আন্তর্জাতিকমোহল থেকেও কল্পনা চাকমার অপহরণের যথাযথ বিচারের দাবী জানানো হয়েছে। চোরে না শুনে ধর্মের কাহিনী, ঠিক সে রকম শাসকশ্রেণিরও কান বধির হয়েছে। সেজন্য পাহাড়ের বিচারের বানী নিরবে নিভৃতে কাঁদে, পাহাড়ের সমস্যাকে গভীরভাবে উপলদ্ধি করার জন্য বাংলাদেশের প্রগতিমনা মানুষ অত্যন্ত কম। যার ফলে কল্পনা চাকমার মত প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক নারীদের অপহরণ করে গুম করা হয়, দীর্ঘ ২৩ বছরেও কল্পনা চাকমার হদিস মিলে না। বিচার পাওয়া তো আকাশ কুসুম কল্পনার সামিল মনে হয়!
আজ ১২ জুন পার্বত্য চট্টগ্রামে নারী সমাজের জাতীয় জাগরণের অগ্রদূত কল্পনা চাকমা অপহরণের ২৩ বছর পূর্ণ হল। আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রাম জুম্ম সমাজের সীমাবদ্ধতা, সামন্তীয় সমাজের পশ্চাৎপদতা এবং শাসকশ্রেণির শত প্রতিকূলতার মাঝেও বেড়ে উঠা একজন আপোষহীন সংগ্রামী নারী হল কল্পনা চাকমা। তাঁর পরিবারের বড় ভাই কালিন্দী কুমার চাকমা, আত্মীয় স্বজন, শুভাকাঙ্ক্ষী, তাঁর প্রিয় সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দ ও পার্বত্য চট্টগ্রামে সর্বস্তরের জনগণ কল্পনা চাকমার দ্রুত হদিস দিতে হবে ও অপহরণের তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ তথা যথাযথ বিচারের দাবীতে সব সময় সোচ্চার ছিলেন, এখনও আছেন। অপহরণের ২৩ বছর পরেও কল্পনা চাকমার হদিস দিতে পারেনা যে রাষ্ট্র! সে রাষ্ট্রের নিয়ম নীতি বিষয়ে মানুষের উদ্বেগ-উৎকন্ঠা প্রকাশ করবে সেটায় স্বাভাবিক। কল্পনা চাকমার অপহরণের তদন্ত ও যথাযথ বিচারের দাবীতে মিছিল, মিটিং, সভা-সমাবেশ, গোল টেবিল আলোচনা, সেমিনার ও আইনগতভাবে লড়াই সবই করা হয়েছিল। কিন্তু তারপরও বলতে বাধ্য হই, হায়রে রাষ্ট্র তুমি কার! তুমি কার প্রতিনিধিত্ব কর? একটা রাষ্ট্রের মালিক হল তাঁর দেশের জনগণ, কল্পনা চাকমাও একজন এদেশের নাগরিক। সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনীর কর্তৃক উৎশৃংখল কর্মকাণ্ড রাষ্ট্রের মালিক জনগণ কখনো মেনে নিতে পারে না। আজ কতিপয় উৎশৃংখল সেনা কর্মকর্তাদের মাধ্যমে বিশাল নিয়ম শৃঙ্খলায় পরিপূর্ণ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হতে চলেছে। দেশ রক্ষার কাজে নিয়োজিত বিশাল সেনাবাহিনী আজ তাদের মধ্যে কতিপয় দায়িত্বরত সেনা কমান্ডার স্ব-স্ব দায়িত্ব থেকে ছড়ে গিয়ে ব্যবসা-বানিজ্য, ব্যক্তিগত স্বার্থেই অধিক মনযোগী হতে বেশি দেখা যায়। যার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামই সেনা কর্মকর্তাদের ডুবাই কাজে যাওয়ার মতোই  কোটি কোটি টাকা লুটপাট করে সম্পত্তির মালিক হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা আর স্বার্থগত সম্পর্ক যেখানে প্রকট সেখানে ন্যায় বিচার পাওয়া তো কল্পনাতীত। পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম নারীর ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা, অপহরণ, গুম ও সকল প্রকার সহিংসতা প্রতিরোধের বিষয়ে গভীর আলোচনার দাবী রাখে। যেখানে মা বোন ও জনগণের নিরাপত্তা নেই, সেখানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতি ব্যতীত কোনদিনই উন্নতি হতে পারে না। রাষ্ট্রের জনগণ ন্যায় বিচার পাবেনা, প্রতিপদে পদে বঞ্চিত হবে। কল্পনা চাকমার পরিবার, আত্মীয় স্বজন ও শুভাকাঙ্ক্ষী সকলেই একই বাস্তবতার সম্মুখীন হয়েছে।
সবশেষ কথা, আমরা চাই এমন একটা সমাজ ব্যবস্থা যেখানে নারী পুরুষের সমান অধিকার থাকবে। এক শ্রেণীর মানুষ অন্য শ্রেণীর মানুষকে শোষণ করতে পারবে না। এক জাতি অন্য জাতির উপর শোষণ,নির্যাতন করতে পারবে না। সব মানুষই মানবিক গুণাবলিতে সমৃদ্ধ হবে, উন্নত সমাজ প্রতিষ্ঠা পাবে এবং জীবন জীবিকাসহ সর্বক্ষেত্রে নারী- পুরুষের সমান সুযোগ – সুবিধা পাবে। এধরনের বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একমাত্র নারী মুক্তি সম্ভব। এই ধরণের সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য আপোষহীন নারী নেত্রী কল্পনা চাকমার সংগ্রাম অব্যাহতভাবে চালিয়েছিলেন। সে সংগ্রাম করতে গিয়ে তিনি শাসকশ্রেণির চোখে হয়ে গেলেন চক্ষুশুল। সেনাবাহিনীর চোখে তিনি হয়ে গেলেন শত্রু। অথচ কল্পনা চাকমার মতো দেশপ্রেমিক, প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক উদারচিন্তাধারার একজন নারী এদেশে খুবই কম। সেজন্য কল্পনা চাকমা একটা আদর্শ ও চেতনার নাম। যুগে যুগে জুম্ম জনগণের মাঝে আদর্শ ও চেতনার বাস্তব প্রমাণ মেলে ধরে  তিনি অজেয় হয়ে থাকবেন। অত্যাচারী শাসকগোষ্ঠীই কল্পনাকে মেরেছিল, কিন্তু তাঁর চেতনাকে মেরে ফেলতে পারেনি। কল্পনা চাকমা চেতনার কোনদিন মৃত্যু নেই!!
সূত্র :জম্মু নিউজ।

Comments are closed.

More News Of This Category