সোমবার, ২০শে মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৬ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

স্বপ্ন ও স্বপ্নযাত্রার এক অদ্ভুত মহাকাব্য!  লা দিভিনা কোমেদিয়া: দি ডিভাইন কমেডি!

সিনহা মনসুর 

অগ্নি দেয় দহ আর তাপ। বায়ূ দেয় শ্বাস। জল দেয় জীবন। কিন্তু এই জীবনকে একজন কবি কি দেন?
কবি দেন স্বপ্ন-বীজ! মানব-জমিনের উর্বর ভূমিতে তিনি ছড়িয়ে দেন সেই স্বপ্ন! সেই বীজ! সেই স্বপ্নের পাখায় ভর দিয়ে এগিয়ে চলে আমাদের সভ্যতা! আমাদের আবহমানতা!আমাদের কৃষ্টি। মানুষ হিসেবে আমাদের ‘আমিত্ব’!
আজ থেকে প্রায় সাড়ে সাতশ’ বছর আগে জন্ম নেয়া একজন কবির মধ্যে এমন কি ছিল যার কারণে আধুনিক বিশ্বের মানুষ আজো তাকে ভুলতে পারেনি?
কে সেই কবি?
কি তার বারতা, কি তার কর্ম!
কবির নাম দুরান্তে দেইলি আলিগিয়েরি। তবে আধুনিক বিশ্বে তিনি দান্তে নামেই সমধিক পরিচিত।তিনি একজন ইতালীয় কবি। জন্ম ইতালির ফ্লোরেন্সে।
দান্তের জন্ম নিয়ে একটি জনশ্রুতি এখনো ইতালীতে প্রচলিত আছে। জনশ্রুতিটি হলো:
দান্তের জন্মের আগে তার মা আলিগহারি নাকি স্বপ্নে দেখেছিলেন তার গর্ভস্থ সন্তান গর্ভ থেকে বের হয়ে ছোট একটি জামগাছে উঠে গেছে! আর কালো কালো পাকা জাম ছিঁড়ে খাচ্ছে। হঠাৎ সে বড় হয়ে ময়ূরে রূপান্তরিত হলো আর পানিতে সাঁতার কাটতে শুরু করলো। স্বপ্নে ময়ূর হয়ে পুত্রকে সাঁতার কাটতে দেখলেও বাস্তবে পুত্রের কীর্তি কিন্তু তিনি দেখে যেতে পারেননি। দান্তের বয়স যখন মাত্র পাঁচ বছর তখন তার মা মারা যান। সতের বছর বয়সে তিনি পিতাকে হারান।
১৩০০ সালে দুরান্তে দেইলি আলিগিয়েরি ওরফে দান্তে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ১৩০১ সালে তার বিরুদ্ধ পক্ষ ক্ষমতায় এলে তিনি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হন। এরপর দান্তে প্রায় ২০ বৎসর নির্বাসিত জীবন যাপন করেন। এক শহর থেকে ঘুরে বেড়ান আরেক শহরে।এ সময় তাকে অনেকেই তাকে ক্ষমতাসীনদের সাথে সমঝোতা করার জন্য পরামর্শ দেন।কিন্তু তিনি তা করেননি। এই সময়েই তিনি লিখেন:
‘How bitter is the taste of another’s bread, how weary is the road of going up and down another’s stairs’!
নির্বাসিত জীবন দান্তের জন্যে সুখের না হলে ইতালীয় সাহিত্যের জন্য এটা ছিল সুখকর,কারন এই সময়েই তিনি লিখেন তার বিখ্যাত মহাকাব্য ‘ লা দিভিনা কমেদিয়া’! ১৪,২৩৩ লাইন বিশিষ্ট এই মহাকাব্যটি আত্মার আত্মকথন!অন্যকথায় একে আত্মার আত্মবিকাশও বলা যায়! এখানে এমন এক মহৎ ভালবাসার কথা বলা হয়েছে যা এর আগে কেউ বলেনি। অকস্মাৎ যেন রহস্যের শুরু আর ধীরে ধীরে রহস্যের গভীরে প্রবেশের চেষ্টা। বিশ্বের সব মানুষের মনের ভিতর গুমরে ওঠা প্রশ্নের একটা ফিরিস্তি এই লা দিভিনো কমেদিয়া’।এর জবাবগুলো রহস্যময়! শুরুতেই দান্তে বলেছেন:
‘In the middle of the journey of our life I found myself within a dark woods where the straight way was lost.’
মহাকাব্যটি লেখেন তিনি স্থানীয় ভেনেশিয়ান কথ্যভাষায়। একে ইতালীয় সাহিত্যের একটি অসাধারণ কাজ এবং বিশ্বসাহিত্যের একটি মাইল ফলক সাহিত্যকর্ম হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। মধ্যযুগে পাশ্চাত্য গির্জাগুলোয় কিভাবে জীবনযাত্রা বিকশিত হয়েছিল, তা দান্তের এই কাব্যের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। ১৪২৩৩ লাইনের এই মহাকাব্য তিন ভাগে বিভক্ত : ইনফেরনো, পুরগাতোরিও এবং পারাদিসো। এগুলোর প্রতিটি আবার ৩৩টি ভাগে বিভক্ত। দান্তে তাঁর এই মহাকাব্যে একটি পরলোক যাত্রার কথা বর্ণনা করেন, যা এই তিন রাজ্যের মধ্য দিয়ে শেষ হয়।
এই মহাকাব্যের অন্যতম চরিত্র বিয়াত্রিচে। পৃথিবীতে ভালোবাসার যেসব বাস্তব কাহিনী রয়েছে, তার মধ্যে দান্তের জীবনের কাহিনীটি যেমন মধুর, তেমনি বিস্ময়কর। তাঁর বয়স যখন ৯ বছর, তখন তাঁর সঙ্গে দেখা হয় বিয়াত্রিচে নামের একটি মেয়ের। মেয়েটির বয়সও ৯ বছর। প্রথম দেখার সময় দুজনের মধ্যে কোনো কথা হয়নি। পরবর্তী সময়ে সারা জীবনে দু-তিনবারের বেশি দুজনের দেখাও হয়নি। কিন্তু দান্তে জানিয়েছেন, প্রথম দেখার দিনই তিনি বিয়াত্রিচের প্রেমে পড়েন এবং এই প্রেম তাঁর সমগ্র জীবনকে নিয়ন্ত্রিত ও মহান করেছে। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, দান্তের এই একনিষ্ঠ ভালোবাসার কথা কখনো জানতে পারেননি বিয়াত্রিচে। একসময় দান্তে ও বিয়াত্রিচে দুজনেরই বিয়ে হয়ে যায় ভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, ১২৯০ সালে মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে বিয়াত্রিচে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পরও দান্তে তাঁকে কখনো ভুলতে পারেননি। ২০ বছর বয়সের সময় থেকে তিনি বিয়াত্রিচের উদ্দেশে কবিতা লিখতে শুরু করেন। ডিভাইন কমেডির মধ্যেও বিয়াত্রিচের প্রসঙ্গ উল্লেখযোগ্যভাবে রয়েছে।
দান্তে ঠিক কখন ডিভাইন কমেডি লিখতে শুরু করেন নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। বিভিন্ন সূত্র মতে, ১৩২১ সালে মৃত্যুর কিছুকাল আগে তিনি এই মহাকাব্য রচনা শেষ করেন। এই মহাকাব্যে বিয়াত্রিচের প্রসঙ্গ থাকলেও এর বিষয়বস্তু কিন্তু প্রেম নয়। এখানে জীবন ও জগৎ সম্পর্কে কবির গভীর দার্শনিক-চিন্তার অত্যন্ত সুন্দর প্রকাশ ঘটেছে।
কাহিনীটি এ রকম যে:
এক বনের মধ্যে দান্তের দেখা হয় প্রাচীন খ্রিস্টপূর্ব যুগের মহাকবি ভার্জিলের সঙ্গে। স্বর্গে অবস্থানরতা বিয়াত্রিচে ওই সময় ভার্জিলকে সেখানে পাঠিয়েছেন। উদ্দ্যেশ্য, ভার্জিল যেন দান্তেকে মৃত্যু-পরবর্তী ভুবনে পথ দেখিয়ে স্বর্গে নিয়ে আসেন। ওই ভ্রমণের নানা বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথাই দান্তে এই মহাকাব্যে বর্ণনা করেছেন। এর মধ্যে স্বর্গ, নরক ও পার্গেটরির বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। যেসব আত্মা শেষ পর্যন্ত ত্রাণ লাভ করে স্বর্গে যাবে, পার্গেটরি বা প্রেতভূমিতে নানা কষ্ট ও পীড়নের মধ্য দিয়ে তাদের পাপ ধুয়ে-মুছে তাদের পবিত্র ও শুদ্ধ করে তোলা হয়। ভার্জিল দান্তেকে প্রথমে নরক, তারপর পার্গেটরি এবং সব শেষে স্বর্গের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেন।
দান্তে বলে উঠেন:
‘Do not be afraid; our fate
Cannot be taken from us; It’s a gift’!
পবিত্র কোরআনে সূরা বণি ইসরাইলে ও কিন্তু বলা হয়েছে:
‘আমি প্রত্যেক মানুষের কর্মকে তার গ্রীবলগ্ন করে রেখেছি’!
ডিভাইন কমেডি ছিলো এক অনন্য সৃষ্টি। দান্তের মৃত্যুর পর দেখা গেলো পাণ্ডুলিপির শেষের অংশকে কে যেন সরিয়ে নিয়েছে। তাঁর দু’ছেলে জ্যাকোপো ও পিয়েত্রে মাসের পর মাস তন্নতন্ন করে খুঁজে চললেন সেই হারানো পাণ্ডুলিপি।
পিতার কাগজপত্র ঘেঁটে ঘেঁটে পিয়েত্রে আর জ্যাকোপো রীতিমতো হয়রান হয়ে গেলেন। শত চেষ্টা করেও পাণ্ডুলিপির শেষ অংশটুকু খুঁজে পেলেন না। অবশেষে সব আশা ছেড়ে দিয়ে অন্য কাজে মন দিলেন তারা।
এভাবে কেটে গেলো আরো কয়টি মাস। তারপর এক রাতে পিয়েত্রে স্বপ্নে দেখতে পেলেন তার পিতাকে। সাদা পোশাক পরিহিত তাদের পিতা, নরম আলোতে এসে দাঁড়ালেন পিয়েত্রের সামনে। পিয়েত্রে তখন তার পিতাকে জিজ্ঞেস করলেন ডিভাইন কমিডির শেষ অংশটুকুর কথা।
পিয়েত্রে বললেন:
‘পিতা! আপনি কি এ মহাকাব্যটি অসম্পূর্ণ রেখেই মারা গিয়েছিলেন, না অন্য কেউ তা চুরি করে নিয়ে গেছে’?
স্বপ্নের ভেতরই দান্তে তাঁর স্নেহময় পুত্রকে জানালেন, মৃত্যুর পর মূল্যবান এ মহাকাব্যটি বেহাত হয়ে যেতে পারে আশঙ্কা করে তিনি পাণ্ডুলিপির শেষাংশটুকু লুকিয়ে রেখেছেন পাশের ঘরের ভেন্টিলেটরের ভেতরে।
সকালে ঘুম থেকে উঠে পিয়েত্রে রাতের স্বপ্নের কথা জানালেন সবাইকে। কিন্তু কেউ বিশ্বাস করলো না তার কথা। আর যারাওবা বিশ্বাস করলো, তারাও তেমন একটা গরজ দেখালো না পাণ্ডুলিপিটি পুনরায় খুঁজে দেখার কাজে।
পিয়েত্রে তখন তার এক আইনজীবী বন্ধুকে খুলে বললেন ঘটনাটি। আর অবাক বিস্ময়ে দেখতে পেলেন, ভেন্টিলেটরের ভেতরে একটি মোটা কাপড়ে জড়ানো রয়েছে অনেক অগোছালো কাগজ। সেগুলোই ডিভাইন কমেডির শেষাংশ!
সেদিন যদি দান্তে স্বপ্নে দেখা দিয়ে পিয়েত্রেকে পাণ্ডুলিপির জায়গাটি না দেখিয়ে দিতেন, তবে হয়তো চিরতরেই তা লুকানো থেকে যেতো। আর ডিভাইন কমিডি পরিচিত হতো একটি অসফল অসম্পূর্ণ পাণ্ডুলিপি হিসেবে।আমাদের সামনে আসতে না দান্তের সেই অমোঘ বানী:
‘From a little spark may burst a flame’!
অথবা
‘The path to paradise begins in hell’!
লেখক:নিউইয়র্ক প্রবাসী

Comments are closed.

More News Of This Category