সোমবার, ২০শে মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৬ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

একজন বরিস পাস্তেরনাক ও ডক্টর জিভাগো!

সিনহা মনসুর 


ইতিহাসের ক্রান্তিকালে প্রতিটি দেশে, প্রতিটি সমাজে কিছু কিছু ক্ষনজন্মা লেখক আবির্ভূত হন।যাদের লেখা সেই সময়ের, সেই দেশের এবং সেই সমাজের চালচিত্র পাল্টে ফেলে।পাল্টে ফেলে গোটা বিশ্বের মনোভাবও! এমনই একজন লেখকের নাম বরিস পাস্তেরনাক। উপন্যাসের নাম-’ডক্টর জিভাগো ‘।বরিস পাস্তেরনাক কবি, দার্শনিক ও গদ্য লেখক। পেশায় চিকিৎসক।জন্ম রাশিয়ায়, ১৮৯০ সালে।রাশন বিপ্লবের সময়ে ছিলেন কবি।’ডক্টর জিভাগো’ বরিস পাস্তেরনাক প্রথম উপন্যাস। বইটি তিনি শেষ করেন ১৯৫৬ সালে। প্রকাশের জন্যে পাঠালেন রুশ সাহিত্য পত্রিকা ‘নোভী মির’-এ।লেখাটি গ্রহনযোগ্য হয়নি।কারন গল্পের মেজাজে ’সোস্যালিষ্ট রিয়েলিজমকে’ হেয় করা হয়েছে!

রাশান বিপ্লব আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্তর্বতীকালীন সময়ের ঘটনা প্রবাহ ’ডক্টর জিভাগো’।সোস্যালিষ্টদের গর্ব অক্টোবর বিপ্লবকে হেয় করার অভিযোগে বইটি রাশিয়াতে প্রকাশের চেষ্টা ব্যর্থ হয়!জিয়ানজিয়াকোমো ফেল্ট্রিনেল্লি নামের এক প্রভাবশালী প্রকাশক বইটিকে লুকিয়ে ইটালির মিলান শহরে নিয়ে আসেন। এখানেই ১৯৫৭ সালে বইটি প্রকাশিত হয় । দু – দশকের ভেতরেই ছয়টি মহাদেশের পাঁচ মিলিয়ন মানুষ বইটি ক্রয় করেন!

প্রকৃত বিচারে ‘ডক্টর জিভাগো’ একটি প্রেমের উপাখ্যান ।দুটি নারীর প্রতি ডক্টর ইউরি জিভাগোর ভালোবাসার টানাপোড়েনের সবেগ উপ্যাখান!
অক্টোবর বিপ্লব, সোস্যালিষ্ট রাশান সমাজের ভেতর একটি আদর্শগত দ্বন্ধের টানাপোড়েন তৈরী করেছিলো। যা শৃংখলিত ওই সমাজকে প্রতিনিয়ত তাড়া করে ফিরেছে! আমাদের গল্পের নায়ক ইউরি জিভাগো সেখান থেকে পালাতে চেয়েছেন! একবার নয়, বারবার! গড়ে তুলতে চেয়েছেন ব্যক্তি চিন্তা , ব্যক্তি পছন্দ ও ব্যক্তি স্বাতন্ত্রের একটি অভয়্যারন্য! জিভাগো এখানে যেন একটি স্বতন্ত্র মানুষের বিদেহী আত্না! স্বতন্ত্র মানুষের প্রতিভু! যার প্রকাশ কবিতায়! জীবনের সব কিছুর ভেতরেই যিনি সুন্দরকে খুঁজে ফেরেন!

বিপত্তি এখানেই। ‘সোস্যালিষ্ট রিয়েলিজম’-এ ব্যক্তি স্বাতন্ত্রের কোন স্থান নেই! ব্যক্তিসত্বা এখানে দম দেয়া পুতুল! ইজমটাই মূখ্য!

১৯৫৮ সালে, বরিস পাসতারনাক,ওই উপন্যাসের জন্যে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনিত হন। কিন্তু ব্যাপারটি রাশান সরকার ভালভাবে নেয় নি। সোভিয়েত সরকারের চাপে এবং তাঁর বিরুদ্ধে চলমান আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি নোবেল পুরস্কার বর্জনের সিদ্ধান্ত নেন। নোবেল কমিটির কাছে লেখা এক পত্রে তিনি উল্লেখ করেন, সোভিয়েত সরকারের প্রতিক্রিয়াই তাঁর পুরস্কার বর্জনের প্রধান কারণ।

সাংবাদিকরা তার কাছে জানতে চেয়েছিলেন, তিনি স্বেচ্ছায় নোবেল প্রত্যাখ্যান করেছিলেন কিনা।
তিনি খুব কড়া ভাষায় জানিয়েছেন:
‘কোনো মানুষই স্বেচ্ছায় এত বড় সম্মান প্রত্যাখ্যান করে না। এ বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমে খুব বাড়াবাড়িই করা হয়েছে। আমার সব ভাবনা আমার বইয়েই আছে… এবং সেগুলো সবসময় থাকবে’!

১৯৫৮ সালে প্রকাশিত সি.আই.এ র একটি রিপোর্টে বলা হয়:
‘বইটি তার অন্তর্নিহিত বক্তব্য আর চিন্তার খোরাক জোগানোর অর্থেই শুধু মহামূল্যবান নয়; মহামূল্যবান এই কারনে যে , বইটি দিয়ে আমরা সোভিয়েত জনগণকে বোঝাতে চাই কেন একজন জীবিত আর গ্রেটেষ্ট সোভিয়েত লেখক তার নিজ ভাষাতে লেখা বই তার নিজ দেশের মানুষদের জন্যে প্রকাশ করতে পারবেন না , নিজ দেশের মানুষকে পড়াতেও পারবেন না ! তাদের সরকারের গলদগুলো কোথায়’!

নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর পরই ক্রুশ্চেভ এর রাশান সিক্রেট পুলিশ ঘিরে ফেলে পাস্তেরনাক সহ তার বন্ধুবান্ধবদের বাড়ী। এমনকি তার রক্ষিতা ওলগা ইভনিস্কায়াকেও পড়তে হয় ঝামেলায়। পাস্তেরনাকের সাথে সম্পর্কের ওলগাকে আগেও একবার কন্সেনট্রেশান ক্যাম্পে যেতে হয়েছিলো! তাকে আবারো কন্সেনট্রেশান ক্যাম্প গুলাগে পাঠানোর হুমকি দেয়া হলো । পিছু হটতে বাধ্য হন পাস্তারনাক। ফিরিয়ে দিতে হয় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্মানের পুরস্কার, নোবেল । নোবেল কমিটির কাছে পাস্তেরনাককে লিখেছিলেন:
‘Considering the meaning this award has been given in the society to which I belong, I must refuse it. Please do not take offense at my voluntary rejection’!

ডক্টর জিভাগো যেন পাস্তেরনাকেরই ‘বিদেহী আত্মা’ বা ‘ইগো’!নিজের মতো করেই ডক্টর জিভাগোকে চিত্রিত করেছেন পাস্তেরনাক! জিভাগো একাধারে কবি, দার্শনিক আবার চিকিৎসক ও । বলশেভিক রাজত্বের নিষ্ঠুরতা আর রূঢ় বাস্তবতার আঘাতে জীবন তার ওষ্ঠাগত!

নায়ক জিভাগোকে প্রথম আমরা দেখি মাটি উপডে ফেলা একটি গাছের মতো।অসহায়! শিশুর মতো! মায়ের কবরের পাশে ক্রন্দনরত!শৈশবে মাকে হারিয়ে ভালোবাসা আর স্নেহের যে নিরাপত্তার বেষ্টনী থেকে জিভাগো ছিটকে পড়েছেন, সারাটি গল্পে সারাটি জীবনে তাকে সেই নিরাপত্তার বেষ্টনীটাই খুঁজতে হয়েছে! খুঁজে পাননি আজীবনও!স্ত্রী তানিয়াকে শুধু বন্ধু হিসেবেই পেয়েছেন । ভালোবাসা,ভরসা, নিরাপত্তা খুঁজে পাননি সেখানে! বিক্ষুব্ধ রাশান মানুষগুলো যখন ছুটছে ক্ষুধায় একটুকরো রুটি পেছনে, বরফ শীতল হাওয়ায় বেঁচে থাকার জন্যে এক টুকরো জ্বালানী কাঠের পেছনে, জিভাগো তখন ছুটছেন ভালোবাসার পেছনে! ছুটেছেন তিনি নির্ভরতা খোঁজে!নিজের ভেতরে খুঁজে ফিরেছেন অতৃপ্ত সেই আকাঙ্খাকে, খুঁজে ফিরেছেন আঁশে-পাশের জন-অরন্যে! ফ্রয়েডীয় ভাষায় এর নাম ‘Maternal Object’! নারীর প্রতি ভালোবাসা আর স্নেহের টান। তাই ছুটেছেন তিনি এক নারী থেকে আর এক নারীতে! কিন্তু পেয়েছেন কি সেই নির্ভরতা?

গল্পের প্রথমেই, লারাকে জড়িয়ে ভালোবাসায় থিতু হতে চেয়েছেন জিভাগো।লারা পরস্ত্রী! যে প্রদীপ আলো দেয়, উষ্ণতা দেয়,তাই তিনি খুঁজে পেয়েছেন লারার মাঝে! তাই বারবার তার কাছেই ফিরে গেছেন ।লারার জন্যে রোমান্টিসিজম আর প্যাশন এর একটি আবহ তৈরী হয়েছিল তার।ভেতরে ভেতরে লালিত হচ্ছিল , সেসব ঘিরে নিজের এক জীবনদর্শন ! ওই জীবন এক ঘোর লাগা জীবন!

সোভিয়েত আইডিঅল্যাজির মাঝে যা ধাক্কা খাচ্ছিলো বারেবারে! তাই, বিপ্লবের প্রতি নিজের বিশ্বাসে স্থির হয়ে থাকা তার আর হয়ে ওঠেনি! নিজের একান্ত ইচ্ছের বিরূদ্ধেও শুধু বিপ্লবের খাতিরে তাকে হত্যা করতে হয়েছে প্রতিবিপ্লবীদের ।এই হত্যা নিজের একানতে নিজের বিশ্বাসকেই যেন ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছে! একবার নয়, বিশ্বাস ভেংগেছে বারবার । শেষতক জিভাগো বুঝতে পেরেছেন বাস্তবের কঠিন শিক্ষাটি । আর তা হচ্ছে:
বিপ্লবের পক্ষ – বিপক্ষ, যে দলেই আপনি থাকুন না কেন আপনার ব্যক্তিগত বলতে কিছু নেই । আপনার ভালোবাসা, স্নেহ, মায়া , মমতার কোন স্থান নেই এই রকম সমাজ ও রাষ্ট্রে !আপনি শুধুই যুথবদ্ধ এক প্রানী , আলাদা কোনও অস্তিত্ব নেই আপনার । আপনাকে শুধু কাঁকাতুয়ার মতো শেখানো বুলিই আউড়ে যেতে হবে । যেখানে প্রানের কোন স্পন্দন স্পন্দিত হবেনা কারো বুকে, অথবা কারো সাহিত্য!

তাইতো, জিভাগো বলেন:
‘তোমাদের নেতারা অনেক কথাই বলেন…কিন্তু তুমি, তোমরা…একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ভুলে যাও যে…তোমরা শক্তি অর্জন করে বেঁচে থাকতে পারবে না! আমি আর এমন কোনো আন্দোলনের কথা জানি না, যেটি এত বেশি আত্মকেন্দ্রিক ও মার্কসিজমের মতাদর্শ থেকে এতটা বিচ্যুত… সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা তাদের সিদ্ধান্তগুলোর আপ্ততা বা নির্ভুলতার দায়সংক্রান্ত বুলির বিস্তার ঘটানোর জন্য সত্যকে পৃষ্ঠদেশ দেখিয়ে সবই করতে পারেন…’!

তবুও জিভাগো সেই বৈরী সময়েও লারাকে নিয়ে লিখে গেছেন সেই নির্মল কবিতা যেখানে বাস্তব উঠে এসেছে কঠিন ভাবে!যে বাস্তব থামিয়ে দিয়েছে দুটি প্রানের উষ্ষ আলিঙ্গনকেও!

‘I’ve let the family go its ways,
All those close to me have long dispersed,
And the usual solitude

Fills all of nature and my heart.
And so I’m here with you in the cabin’!

উপন্যাসের আদলে এই চরিত্র গুলো সাধারন, আমাদের চারপাশের।কিন্তু আখ্যান বিচারে মহাকাব্যিক!যে নারীতে নিমজ্জিত ছিল জিভাগোর ব্যক্তিমানস , সেই লারিসা ফিওদরভনা ( লারা) ও হারিয়ে গেছেন তার জীবন থেকে জীবন অরন্যে! গল্পে ধারনা দেয়া হয়, লারা হয় গ্রেফতার হয়েছেন রাস্তায়, নয়তো মারা গেছেন অজানা কোন শহরে! অথবা আছেন, অসংখ্য উওম্যান কনসেনট্রেশান ক্যাম্পের কোনও একটিতে ।হারিয়ে যাওয়া মানুষের তালিকার নীচে চাপা পড়ে গেছে লারা নামটি! যেভাবে চাপা পড়ে আরো কত নাম না জানা লারা! একজন জিভাগো তাকে খুঁজে ফিরছেন, সারাটি জীবনভর!

পাদটীকা:
১৯৮৭ সাল।মিখাইল গর্ভাচেভ এর ডেমোক্রাটিক রিফর্ম কালে পাস্তেরনাককে আবার ফিরিয়ে আনা হয় বদলে যাওয়া রাশান সমাজে! আর প্রত্যাবর্তন ঘটে তার নিজ ভাষাতে লেখা বই ‘ডক্টর জিভাগো’!

লেখক: সিনহা মনসুর

নিউইয়র্ক

Comments are closed.

More News Of This Category