রবিবার, ৯ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ২৬শে মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

হাজীগঞ্জে লীজের ভিপি সম্পত্তি  বেচাকেনার পাঁয়তারা! 

বিশেষ প্রতিবেদক,চাঁদপুর

চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে খতিয়ান জাল জালিয়াতি করে লীজকৃত ভিপি সম্পত্তি বেচাকেনার পায়তারা করার অভিযোগ উঠেছে।লিজগ্রহিতাদের কেউ কেউ ভিপি সম্পত্তির ভুয়া দলিল সৃজন করে ব্যাংকে বন্ধক রেখে কোটি টাকা লেনদেনসহ সরকারী সম্পত্তি আত্মসাতের অপচেষ্টা করলেও সরকারি সম্পত্তি রক্ষায় রহস্যজনক কারণে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কতিপয়  কর্তাব্যক্তিদের অপতৎপরতা লক্ষ্য করা গেছে।ক্রাইম রিপোর্টে অনুসন্ধানে লীজকৃত সম্পত্তির বিভিন্ন নথির তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া যায়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে,চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জ উপজেলার ২১৩ নং মকিমাবাদ মৌজায় ১৬৯ নং খতিয়ানের ৯৮ শতাংশ ভূমি সরকারি ভিপি তালিকাভুক্ত।সম্পত্তি সংক্রান্ত বিভিন্ন নথিপত্র তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনায় দেখা যায়,চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জ উপজেলার ২১৩ নং মকিমাবাদ মৌজার সিএস ৯৮নং এবং  পরবর্তীতে আর.এস ১৬৯নং খতিয়ানে সিএস এসএ ৫৮৯ দাগে ২৭ শতাংশ ও ৫৯১নং দাগে এক একর ৬৮ শতাংশ ভূমি ছিলো।মোট দুই একর আট শতাংশ ভূমির মালিক ও ভোগদখলকার ছিলেন বিহারী লাল বনিকের পূত্র কালি প্রসন্ন বনিক,গৌরাঙ্গ চন্দ্র সাহার পূত্র বেনু লাল সাহা,ইন্দ্রলাল বিপীল বিহারী সাহা এবং বৃন্দাবন মালির পূত্র হারিপদ সাহা,মহেন্দ্র লাল ও নিমচন্দ্র সাহা ভোগদখলে ছিল।
অপরদিকে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন,২০০১ মোতাবেক আনীত ‘ক’ তফসিল তালিকা ভূক্ত অর্পিত সম্পত্তি অবমুক্তির প্রার্থনায় দায়ের করা মোকদ্দমার(অর্পিত-৭৩/২০১২,২৫৬/১৮) তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়,দুই একর ৩৫ শতাংশ ভূমির সিএস রেকর্ডীয় মালিক দেখানো হয় বৃন্দাবন মালি,নবীন চন্দ্র মালি ও মহিম চন্দ্র মালিকে।পরবর্তী নবীন চন্দ্র মালি নিঃসন্তান অবস্থায় মারা যান ফলে তাঁর অপর দুই ভাই বৃন্দাবন ও মহিম ভাইয়ের ওয়ারিশপ্রাপ্ত ভূমির মালিক হন।বৃন্দাবন মালি মৃত্যুকালে নিবারন চন্দ্র নামে এক পূত্রকে ওয়ারিশ রেখে মৃত্যুবরণ করলে নিবারণ চন্দ্র পিতার সম্পত্তির মালিক হন।সে অনুযায়ী মহিম ও নিবারণের মধ্যে আপোষ বন্টনে নিবারণ নালিশী ৯৮ খতিয়ানে এবং বেনালিশী ৯৯ খতিয়ানে একা ভোগদখলকার থাকিয়া নালিশী বেনালিশী এক একর ১৯ শতাংশ ভূমি বিক্রি করেন মুকুন্দ লাল সাহা গংদের নিকট।
বৃন্দাবন চন্দ্র মালী মৃত্যুকালে নিবারন চন্দ্র মালীকে ওয়ারিশ রাখিয়া যান উক্ত নিবারন চন্দ্র মালী তিন পুত্র নারায়ন মালী, অর্জুন চন্দ্র মালী এবং মরন চন্দ্র মালীকে ওয়ারিশ রাখিয়া মত্যুবরন করেন। অর্জুন চন্দ্র মালী দুই পূত্র পলাশ  ও শ্যামলকে রাখিরা মৃত্যুবরন করেন এবং মরন চন্দ্র মালী তিন পুত্র নন্দলাল মালী, বিশ্বজিৎ মালী, ইন্দ্রজিৎ মালীকে ওয়ারিশ রাখিয়া মৃত্যুবরন করলে নালিশী খতিয়ানের ভূমিতে পুরুষানুসারে ওয়ারিশসূত্রে মালিক ও ভোগ দখলকার হিসেবে থাকেন।পরবর্তীতে সিএস ৯৮নং খতিয়ানের ভূমি আরএস ১৬৯নং খতিয়ানে রেকর্ড হয়। আরএস ১৬৯নং খতিয়ানে নিবারন চন্দ্র মালীর নাম সঠিক ও শুদ্ধরুপে রেকর্ড হয়।
জনৈক বলহরি বনিক পিতামৃত বিহারী লাল বনিক, ত্রিপুরা সুন্দরী বনিক পতিমৃত নিত্যানন্দ বনিক এবং বসন্ত কুমারী বনিক পতিমৃত দ্বীনবন্ধু বনিক বাদীগনের পূর্ববর্তী সৌদামিনি মালী ও নিবারন চন্দ্র মালী ও নবীন চন্দ্র মালী গং এর নাম ব্যবহারে নালিশী ৫৯১ দাগের ভূমিতে গোপনে বিভিন্ন দলিল সৃজন করে রাখে।সেই দলিলের সূত্রে বলহরি গং এর ওয়ারিশ দাবি করে বিজ্ঞ আদালতের ৭৩/২০১২ নং স্বত্ত্ব মোকদ্দমার মামলা দায়ের করে বাদী সঞ্জীব কুমার বনিক।সিএস ৯৮ আর এস ১৬৯ খতিয়ানে বন্টনের দাবিতে সঞ্জিব কুমার বণিক বিজ্ঞ কুমিল্লা ৩য় সাব জজ আদালতে ১৯৬/৭৪ নং স্বত্ত্ব বন্টন মোকদ্দমা দায়ের করে। বিজ্ঞ আদালতে সে মামলা খারিজ হয় দলিলে ত্রুটির কারণে।রায় ডিক্রির অসম্মতিতে সঞ্জিব কুমার বনিক উর্ধতন আদালতে মোকদ্দমা দায়ের করেও তাঁহার স্বত্ত্ব প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়।সঞ্জীব কুমার বনিকের কোন স্বত্ব দখল মালিকানা ছিল না বা অর্জিত  হয়নি বলে বর্ণিত ১৯৬/১৯৭৪ইং মোকদ্দমা বিগত ৩০/০০/১৯৭৭ইং তারিখে দো-তরফা সূত্রে ডিসমিস হয়।ফলে নিবারন চন্দ্র মালির সম্পত্তির মালিক ও দখলকার স্বার্থ স্বত্ত্ব বহাল থাকে। অপরদিকে বাদীগনের দখককৃত তফসিল ভূমি অর্পিত সম্পত্তির “ক” তফসিল তালিকায় লিপিবদ্ধ হয়।এমনকি বাদীগণ উল্লেখিত সম্পত্তিতেই ভোগদখলে থাকেন।
এরই সূত্রধরে সরকার ২৩০/৭৩-৭৪ ভিপি লীজ কেইসমূলে বাদীগণের পূর্ববর্তী ওয়ারিশগণকে উচ্ছেদ না করে  তাদের নামে অস্থায়ী লীজ প্রদান করে। লিজের সূত্র ধরেই বংশপরম্পরায় বর্তমানের লীজগ্রহিতাদের বংশধরগণ লীজের সম্পত্তিতে লীজমানি পরিশোধ করে বসবাস করে আসছেন।
সরকার কতৃক লীজকৃত মকিমাবাদ মৌজার সাবেক ৫৯১ দাগের  ১৫৩৩,১৫৩৪,১৫৩৫,১৫৩৯,১৫৪০,১৫৪১,১৫৪২,১৫৪৬ হালদাগ ২৩০/৭৩-৭৪ ভিপি লীজ কেইস মোকদ্দমামূলে সরকারি ১/১ খতিয়ানভূক্ত ভূমি।এই সরকারি ভিপি সম্পত্তিতে দখলকার থাকাকালীন অবস্থায় ১৬৯ এসএ খতিয়ানমূলে ৫৮৯ দাগে দুই একর ৭০ শতাংশ এবং শুধুমাত্র ৫৯১ দাগে ৯৮ শতাংশ ভিপি সম্পত্তি রয়েছে বলে অনুসন্ধানকালে জানা গেছে।
কিন্তু লীজকৃত সম্পত্তির মধ্যে ১৫৩৪ দাগে সঞ্জিব কুমার বনিকের নামে বিআরএস ১৭৬৩ নম্বর খতিয়ান সৃজন হয়।সঞ্জিব কুমার বনিকের খতিয়ানের সূত্র ধরে তারই দুই পূত্র কৌশিক বনিক ও কৃষাণ বনিকের নামে আবার নামজারি খতিয়ান ২৮৫৭ সৃজন করা হয়। যদিও ২৮৫৭ খতিয়ানের নামজারি কেইস মোকদ্দমা নম্বর কোথাও উল্লেখ নেই।১৫৩৪ দাগে অর্জুন চন্দ্র মালির নামে ৪২ নম্বর,নারায়ণ চন্দ্র মালির নামে ১১০৯ নম্বর মরণ চন্দ্র মালির নামে ১৪৬৪ নম্বর বিআরএস খতিয়ান সৃজন করা হয়।কিভাবে এসব খতিয়ান সৃজন করা হয় হাজীগঞ্জ উপজেলা ভূমি অফিসের কতিপয় কর্মকর্তা এই প্রশ্নের সদুত্তর না  দিয়ে তথ্য গোপন করতে তৎপর থাকেন।
অনুসন্ধানকালে দেখা গেছে,৫৯১ দাগের সরকারি ভিপি লীজের সম্যক  ভূমিতে ব্যবসা- বাণিজ্য সম্প্রসারণের লক্ষ্যে অস্থায়ী অবকাঠামো (দোকানঘর) নির্মাণ করে হাজীগঞ্জ পৌরসভা।কিন্তু সেই দোকানঘর বিক্রি করেও কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন একটি স্বার্থান্বেষী মহল।পৌরসভা কতৃক নির্মিত দোকানঘরের পজিশন এখনও বিক্রি হচ্ছে বলে অনুসন্ধানে চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসে।একই ভিপি সম্পত্তির নামে ভূয়া দলীল সৃজন করে কোটি টাকা ব্যাংক লোন নিয়েছেন লীজগ্রহিতাদের কেউ কেউ।কেউ কেউ লীজের সম্পত্তি বিক্রি করে ভারতে চলে যাওয়ার চক কষছেন ইতোমধ্যে।আবার কেউ সাব লিজ দিয়ে হাতিয়ে নিয়েছেন লাখ লাখ টাকা। অপর একটি স্বার্থান্বেষী মহল বর্তমানে এই সরকারি ভূমি দখলের পায়তারা করছেন বিভিন্ন অযুহাত তুলে।এই ভিপি সম্পত্তি আত্মসাতের চেষ্টারত পরাজিত শক্তি বর্তমানে ভূমি সংশ্লিষ্ট অসাধু কতিপয়  কর্মকর্তাদের মোটা অংকের ঘুষ দিয়ে ম্যানেজ করার চেষ্টা করছেন।যারা বিগত সময়ে অবৈধ উপায়ে সরকারি সম্পত্তি জবরদখলের পাঁয়তারা করে আসছেন।
অপরদিকে বিগত দিনে যারা পূর্বপুরুষদের মালিকানাধীন ভোগদখলে থাকা সম্পত্তি (পরে ১/১) খতিয়ানে লিপিবদ্ধ হওয়ায় বিভিন্ন চড়াই উৎরাই পেরিয়ে লীজ পেয়েছেন তাদেরকেই উচ্ছেদের পায়তারা করছেন স্থানীয় প্রশাসনের অসাধু কর্তাব্যক্তিরা।যদিও খতিয়ান জালিয়াতি করে এই ভিপি সম্পত্তিকে পুঁজি করে বিভিন্ন আর্থিক লেনদেন সহ লীজের শর্তভঙ করার পরও অসাধু চক্রের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেয়নি সংশ্লিষ্টরা। সরকারের পক্ষে সরকারি সম্পত্তি রক্ষায় যারা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বিভিন্ন উপায়ে তাদেরকেই উচ্ছেদ করে তাদের বিরুদ্ধেই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছেন একটি স্বার্থান্বেষী মহলসহ সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের সুবিধাভোগী অসাধু কতিপয় কর্মকর্তা।এতে সরকারি স্বার্থ দেখার যেন কেউ নেই!
এ বিষয়ে হাজীগঞ্জ উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) রিফাত জাহান শেয়ার বিজকে বলেন,লিজের শর্ত ভঙ্গ করায় আমরা একটি দোকান বন্ধ করে দিয়েছি।লিজের সম্পত্তিতে কিভাবে খতিয়ান সৃজন করেছে লীজগ্রহিতাদের কেউ কেউ?এই প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, তা আমাদের জানা নেই।তথ্য প্রমাণ পেলে আমরা ব্যবস্থা নিব।
লীজগ্রহিতা বিশ্বজিৎ বলেন,ষড়যন্ত করে আমাদের উচ্ছেদ করার পাঁয়তারা করছে একটি স্বার্থান্বেষী মহল।আমার পূর্বপুরুষগণ এ সম্পত্তিতে বসবাস করে আসছেন প্রায় ৭৮ বছর পর্যন্ত। সে সুবাধে সরকার আমাদের লিজ দিয়েছে।

Comments are closed.

More News Of This Category