শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১৩ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সুরজাহান বিবি ও একজন পরাজিত র‍্যাব কর্মকর্তা…


শামীম আনোয়ার 


বৃদ্ধা ক্রমাগত গাড়ির জানলার কাঁচে টোকা দিয়ে চলেছেন। বেশিরভাগ ভিক্ষুক যেখানে সাধারণত ভিক্ষা চাইতে র‍্যাবের গাড়ির কাছে আসার আগ্রহই দেখাতে চায় না, সেখানে এই মহিলা কিনা…..! খানিকটা বিরক্তি নিয়েই দশ টাকার নোট একটা বাড়িয়ে ধরলাম। আপদটা বিদায় করা দরকার। কিন্তু কী অদ্ভুত! আমাকে বিস্মিত করে দিয়ে তিনি নোট ফিরিয়ে দিলেন। তাঁর নাকি টাকার দরকার নেই, শুধু একটু কথা বলতে চান।

মাস দুয়েক আগের কথা। হবিগঞ্জ জেলার শায়েস্তাগঞ্জ মোড়। একটা হত্যা মামলার ছায়া তদন্তের (Shadow Investigation) কাজে সোর্সের সাথে কথা বলার জন্য গাড়িতে বসে অপেক্ষা করছি। তখন ঠিক এভাবেই ভদ্রমহিলার আগমন। অগত্যা বিরস বদনে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালাম। বৃদ্ধা বলতে শুরু করলেন। গল্প। জীবনের গল্প।

কম বয়সেই স্বামী হারিয়েছিলেন সুরজাহান বিবি। তখন তাঁর বলতে শুধু তিন শিশু সন্তান ও স্বামীর রেখে যাওয়া যৎসামান্য জমিজিরেত। প্রতিকূল স্রোতে জীবন সংগ্রাম আর সন্তানদের ভবিষ্যত চিন্তা- সবমিলিয়ে অকূল পাথারে পড়ে যান মধ্যত্রিশের সুরজাহান। বিয়েথা করে নতুনভাবে সংসার পাতা বা বাবার বাড়ির আশ্রয়ে চলে যাওয়াটাই ছিল নিরাপদ পথ। কিন্তু না! আজন্ম জেদী আর সাহসী সুরজাহান একটু ভিন্ন পথেই হাঁটতে চাইলেন। সন্তানদের নিয়ে স্বামীর ভিটেতেই মাথা গুজে থাকবেন তিনি। তিন শিশু পুত্রকে মানুষ করাকেই গ্রহণ করবেন জীবনের একমাত্র ব্রত হিসেবে। একসময় তো ছেলেরা বড় হবে। এই অভাব-অনটন- টানাটানির সময় ফুরোবে তখন। ছেলে -বউ- নাতিপুতি নিয়ে কত সুন্দর দিনই না যাবে সুজাহানের!

এসবই বিশ বছর আগেকার গল্প। এখন ছেলেরা বড় হয়েছে। ছোটখাটো বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত। বউ বাচ্চা নিয়ে ভালই চলছে তাদের। আর সেসময় যৌবনাবতী শক্তসমর্থ সুরজাহানও উপনীত হয়ে গেছেন জীবন সায়াহ্নে। সংসার- সন্তানদের নিয়ে সব স্বপ্নই প্রায় পূরণ হয়েছে, শুধু সুরজাহান নিজেই হয়ে পড়েছেন ব্রাত্য।

পালাক্রমে তিন ছেলের ঘরে তিন দিন খাওয়ার ব্যবস্থা তাঁর। বেশিরভাগ সময় পঁচা, বাসী, অন্যদের খাওয়ার পর বেঁচে যাওয়া খাবারটাই কপালে জোটে। আবার খাওয়ার দিন-ঠিকুজী নিয়ে বউদের মধ্যে ঝগড়া বেঁধে যায় কখনো কখনো । সে সময় এ ঘর ও ঘরের ঠেলাঠেলিতে প্রায়শই না খেয়ে থাকতে হয় সুরজাহানকে।

হবিগঞ্জের আধা সিলেটি আঞ্চলিক ভাষায় বলা ঘটনার আদ্যোপান্ত ধৈর্য ধরে শুনলেও আমি বিষয়টা তেমন গুরুত্বের সাথে নিই নি। র‍্যাব অফিসে এরকম পারিবারিক সমস্যা তো হাজারে হাজারে আসে। কয়জনেরটা সলভ করব। শুধু স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের সহায়তায় একদিন মহিলার তিন ছেলেকে ক্যাম্পে ডেকে তাদেরকে এ বিষয়ে একটু বলে দিয়েছিলাম। চেয়ারম্যানকে অনুরোধ করেছিলাম বিষয়টা একটু লক্ষ রাখতে।

কাজের চাপে আর খোঁজও নিতে পারিনি। অনেস্টলি বলতে গেলে, আসলে ভুলেই গেছিলাম। আজ সকালে অফিসে যেয়ে রুটিন অনুযায়ী এক এক করে সাক্ষাৎ প্রার্থীদেরকে সমস্যার কথা শুনছি। হঠাৎ দেখি সেই তিনি আবার হাজির। দেখে অবিশ্যি চিনতে পারলাম। আবার নতুন কোন ঝামেলা নয় তো!! ভদ্রমহিলা সহাস্যে জানালেন, তিনি ভাল আছেন। খাবারের বিষয়টার সম্মানজনক হিল্লে হয়েছে। ছেলে- ছেলেবউরাও এখন বেশ যত্নবান। শরীর একটু অসুস্থ হলেও সুখেই নাকি আছেন।

এ পর্যন্ত সবই ঠিক ছিল। হঠাৎ দেখি, অনেকদিনের অপরিষ্কার রঙ চটে যাওয়া হলুদ শাড়ির কোনার গিঁট খুলে ভদ্রমহিলা কি যেন বের করা শুরু করেছেন। মাঝারি সাইজের দুইটা তেলের পিঠা। “বড় বউয়ে ফিঠা বানাইছিল, আমারে দুইঠা দিছিল খাওয়ার লাগি।
না খাইয়া তোমার লাগি লইয়া আইছি”। শুনে ভেতরটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠল। মাঝে ক’দিন টেকনাফে থাকার আগেপরে মিলিয়ে আমার সিলেটে অবস্থান এক বছরের বেশি হয়ে গেছে। ইনশাআল্লাহ চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি, টাকা-পয়সা দূরের কথা, র‍্যাবের এএসপি পদে দায়িত্বে থাকার সুযোগ নিয়ে কারো কাছ থেকে এক কাপ চা খেয়েছি- এমন দাবিও কেউ করতে পারবে না।

বুঝতে পারলাম, আজ আমার পরাজয়ের ক্ষণ হাজির হয়ে গেছে। কারো কাছ থেকে কোন বিনিময় গ্রহণ না করার সেই অহংকারের জায়গাটি আর ধরে রাখা গেল না। আমি হাত বাড়িয়ে পিঠা দুটি নিয়ে ফেললাম। আশ্চর্য হয়ে দেখি, বৃদ্ধার দুচোখের পাতা ভিজতে শুরু করেছে। তিনি জানালেন, আমাকে ধন্যবাদ জানাতেই নাকি তাঁর এত দূর থেকে ছুটে আসা। একদিকে অশ্রুধারা অন্যদিকে প্রায় সব দাত পড়ে যাওয়া মুখাবয়বে অদ্ভুত মিষ্টি হাসি। কথার উত্তর না দিয়ে আমি শুধু একটু হাসি বিনিময় করলাম। মনে মনে বললাম- “ধন্যবাদ তো আসলে আপনারই প্রাপ্য। আপনার মতো লাখো মানুষের জীবন সংগ্রামের ফসল হিসেবেই আমরা আজ এএসপি, ম্যাজিস্ট্রেট, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যাংকার… ভাল থাকুন মা।”

ফ্রেন্ড লিস্টে যারা আছেন, সবার নিকট অনুরোধ – দয়া করে বৃদ্ধ অক্ষম বাবামা-শ্বশুরশাশুড়ির প্রতি সর্বোচ্চ সংবেদনশীল ও যত্নবান হোন। আর আপনার আশপাশে যদি এমন অমানবিকতা সংঘটিত হতে দেখেন, বিষয়টি স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গোচরীভূত করতে ভুলবেন না। মনে রাখবেন, আজ তাঁরা যে অবস্থায় আছেন, একদিন সে অবস্থায় উপনীত হব আপনি আমিও।

লেখক :শামীম আনোয়ার 
সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি)
র‍্যাব-৯, সিলেট

Comments are closed.

More News Of This Category