সোমবার, ৬ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২৩শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বঙ্গবন্ধু-আওয়ামীলীগ- বাংলাদেশ একই সূত্রে গাঁথা

মতামত


২৩ জুন আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা দিবস। গত শতাব্দীর মধ্য ভাগে, ১৯৪৯ সালের ২৩ ও ২৪ জুন প্রগতিবাদী নেতাদের উদ্যোগে আহূত এক কর্মী সম্মেলনে পুরনো ঢাকার ঐতিহ্যবাহী রোজ গার্ডেনে বাঙালি জাতির মুক্তির বারতা নিয়ে এই সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল।

বস্তত এটিই ছিল তদানীন্তন পাকিস্তানের সরকারি মুসলিম লীগ বিরোধী প্রথম কার্যকর বিরোধী দল। অখণ্ড ভারতের রাজনৈতিক দলগুলোর ধারাবাহিকতায় মুসলিম লীগ ছাড়াও, কংগ্রেস, কমিউনিস্ট পার্টি, তফসিলী ফেডারেশন প্রভৃতি রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব থাকলেও, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এসব দল পূর্ব বাংলার গণমানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিনিধিত্বকারী গণপ্রতিষ্ঠান হিসেবে আর উঠে দাঁড়াতে পারেনি। সামপ্রদায়িক ভেদ-বিভেদ, মুসলিম লীগের দমননীতি এবং ভয়-ভীতিতো ছিলই, সর্বোপরি তৎকালীন উদীয়মান বাঙালি মধ্যবিত্তের সামাজিক, রাজনৈতিক আবেগ, অনুভূতি এবং আশা-আকাঙ্ক্ষা অনুধাবনে কোন দলই সক্ষম ছিল না। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাঙালি জাতিসত্তার স্বাতন্ত্র্যের অস্বীকৃতি বাঙালি জাতিকে এক অভিনব বাস্তবতার মুখোমুখি এনে দাঁড় করায়।১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর মতো দিকপাল নেতাদের সঙ্গে মুসলিম লীগের দূরত্ব, উদীয়মান তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর সহকর্মীদের দ্রোহ ও আত্মত্যাগ পরিস্থিতির ঐতিহাসিক নিয়তি নির্ধারণ করে দেয়। দিক-নির্দেশনা এবং নেতৃত্বহীন অসংগঠিত জনতাকে সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক লক্ষে আর্থ-সামাজিক কর্মসূচির ভিত্তিতে সংগঠিত করা এবং মুসলিম লীগের বিকল্প গড়ে তোলার তাগিদ সৃষ্টি হয়। এই বাস্তবতা থেকেই উৎসারিত হয় আওয়ামী লীগের মতো একটি জাতীয় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার অপরিহার্যতা। এক কথায় বলতে গেলে সংগ্রামের মধ্য দিয়েই আওয়ামী লীগের জন্ম এবং জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে চেতনায় ধারণ করে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণই এই সংগঠনটির বিকাশমান ধারা আজ অবধি অব্যাহত রয়েছে।

ভাষা আন্দোলন, খাদ্য আন্দোলন, মুসলিম লীগ বিরোধী ২১ দফা প্রণয়ন ও যুক্তফ্রন্ট গঠন, ‘৫৪-এর নির্বাচনে বিজয় ও মুসলিম লীগের ভরাডুবি প্রভৃতি ঘটনার ভেতর দিয়ে ‍‍’৫০-এর দশকেই আওয়ামী লীগ হয়ে ওঠে পূর্ববাংলার রাজনৈতিক ভরকেন্দ্র বা প্রধান চালিকাশক্তি। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর জাতিগত নিপীড়ন, শোষণ-বঞ্চনা, বৈষম্য এবং অব্যাহত স্বৈরশাসন ক্রমশঃ বাঙালি জাতির মোহমুক্তি ঘটায়। পাকিস্তানি ধর্ম সামপ্রদায়িক ভাবধারার আচ্ছন্নতা কাটিয়ে ধীরে ধীরে আত্মসম্বিৎ ফিরে পায় বাঙালি জাতি। এরই পটভূমিকায় বাঙালি জাতীয়তাবোধের স্ফূরণ, বিকাশ ও বাঙালির স্বতন্ত্র জাতিরাষ্ট্রের ধারণাকে জনচিত্তে প্রথিত করা এবং অপ্রতিরোধ্য করে তোলার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ পালন করে নিয়ামক ভূমিকা।‍’৬০-এর দশকে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন, ”দুই অর্থনীতি”র তত্ত্ব প্রচার এবং ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ৬-দফা দাবি হয়ে ওঠে স্বাধিকার আন্দোলনের মেগনাকার্টা, পূর্ণ স্বাধীনতাই যার যৌক্তিক পরিণতি। ৬-দফা ভিত্তিক ছাত্র সমাজের ১১-দফা, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার এবং বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে সৃষ্ট ‍‍’৬৯-এর গণঅভ্যুথান, ৭০-এর নির্বাচনে ৬-দফার পক্ষে গণরায় এবং আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় পাকিস্তানের রাজনৈতিক ভারসাম্য বদলে দেয়। আওয়ামী লীগ আত্মপ্রকাশ করে কেবল পূর্ব বাংলার নয়, পাকিস্তানেরও সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল হিসেবে। পক্ষান্তরে, বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেন বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা এবং বাঙালি জাতির পক্ষে কথা বলার একমাত্র বৈধ কর্তৃত্বের অধিকারী।

সাংবিধানিক, শান্তিপূর্ণ ও সশস্ত্র সংগ্রামের অভূতপূর্ব সমন্বয় ঘটিয়ে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির হাজার বছরের স্বপ্ন-সাধনাকে সার্থক করে তোলেন। অসহযোগ আন্দোলন, ৭ মার্চের দিক-নির্দেশনামূলক ঐতিহাসিক ভাষণ, বাংলার মানুষের অকাতরে আত্মদান সত্ত্বেও শান্তিপূর্ণ সকল পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। পাকিস্তানি সামরিক জান্তা শান্তি-প্রিয় বাঙালিদের ওপর কাপুরুষোচিত হামলা চালায়। ১৯৭১-এর ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে গ্রেফতারের পূর্ব মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তাঁর আহ্বানে বাঙালি জাতি ঝাঁপিয়ে পড়ে সশস্ত্র সংগ্রামে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আওয়ামী লীগের পরিচালনায় সংঘটিত মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জিত হয়। ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর বিশ্বের মানচিত্রে সগৌরবে স্থান করে নেয় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ।

বঙ্গবন্ধু আজীবন দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর সাধনা করেছেন। মাত্র সাড়ে তিন বছরে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন সরকার শূন্য হাতে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠন ও নতুন প্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলার দুরূহ কর্তব্য সম্পাদনের পাশাপাশি অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রেও তাৎপর্যপূর্ণ সাফল্য অর্জন করেন। যেমন ১৯৭৩-৭৪ অর্থ বছরে এযাবতকালের সর্বোচ্চ ৯.৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধির হার অর্জনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু দুঃখী মানুষের দারিদ্র্য নিরসনের লক্ষে বাংলাদেশের সামনে উন্নয়ন-সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য বাঙালি জাতির। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতার পরাজিত শত্রুরা জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। প্রতিবিপ্লবী ঘাতকচক্র রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে। মাত্র ৭৯ দিনের ব্যবধানে ৩ নভেম্বর কারাগারে আটক বঙ্গবন্ধুর যোগ্য সহকর্মী মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ, মন্ত্রী এম. মনসুর আলী ও এএইচএম কামারুজ্জামানকে একই ঘাতকচক্র হত্যা করে। রক্তাক্ত পথে ক্ষমতা দখল করে সামরিক স্বৈরশাসক একনায়ক জেনারেল জিয়া। বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের কূটনৈতিক মিশনে চাকরি দিয়ে করে পুরস্কৃত। আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করার লক্ষে পরিচালিত হয় হিংস্র দমননীতি।

বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের ভেতর দিয়ে সূচিত হয় স্বৈরশাসনের ধারা। হত্যা-ক্যু, ষড়যন্ত্র, কারচুপি ও ভোটারবিহীন নির্বাচন হয়ে দাঁড়ায় ক্ষমতা বদলের উপায়। রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে, ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার লক্ষে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সামরিক ছাউনিতে বসে রাজনৈতিক দল গঠন এবং প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে সেসব দলকে রাষ্ট্রক্ষমতায় বসিয়ে বেসামরিক পোশাকে চলতে থাকে সামরিক স্বৈরশাসনের ধারা।

১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬-এর মার্চ পর্যন্ত প্রায় ২১ বছর মোস্তাক-জিয়া-সাত্তারচক্রের সূচিত স্বৈরশাসন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের চরিত্র বৈশিষ্ট্যকেই পাল্টে দেয়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার মধ্যেই বিষয়টি সীমাবদ্ধ থাকে না। স্বৈরশাসকরা বঙ্গবন্ধু আদর্শ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অর্জনসমূহকে ধ্বংস করার চেষ্টা চালায়। বাঙালি জাতিসত্তার আত্মপরিচয়ের মীমাংসিত প্রশ্নকে অমীমাংসিত করে তোলে। বন্দুকের নল দেখিয়ে সামরিক ফরমান বলে যথেচ্ছভাবে পবিত্র সংবিধানকে ক্ষত-বিক্ষত করে। সংবিধান থেকে ধর্ম-নিরপেক্ষতা কেটে দেয়, সমাজতন্ত্রের নতুন ব্যাখ্যা হাজির করে এবং বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের নামে অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও মুক্তিযুদ্ধের রণধ্বনি ‘জয় বাংলা’-কে করে নির্বাসিত। সামরিক একনায়ক জিয়া ও তার উত্তসূরীরা বাংলাদেশকে একটি সামপ্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য সাধ্যমতো সবকিছু করে। বঙ্গবন্ধুর নাম পর্যন্ত উচ্চারণ নিষিদ্ধ হয়। সর্বগ্রাসী ইতিহাস বিকৃতি মুক্তিযুদ্ধের গৌরব, জাতির জনকের অবদান এবং আওয়ামী লীগের ভূমিকাকে মুছে দিতে চায়। গণতন্ত্র, ভোট ও ভাতের অধিকার হয় অপহৃত। দেশের উন্নয়ন-সম্ভাবনা পড়ে মুখ থুবড়ে। কায়েম হয় এক অন্ধকারের রাজত্ব।
দেশ ও জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ শত সংগ্রামে পরীক্ষিত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এই অবস্থাকে মেনে নেয়নি। জেল-জুলুম, নির্যাতন উপেক্ষা করে এবং শত শত কর্মীর অকাতর আত্মদানের মাধ্যমে সামরিক-অসামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। জনগণের অকুণ্ঠ ভালোবাসা, নেতা-কর্মীদের অঙ্গীকার ও ত্যাগ-তিতিক্ষা আওয়ামী লীগকে পুনরায় সংগঠিত করে তোলে।১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মানবতার শত্রু, ঘৃণ্য ঘাতকদের হাতে সপরিবারে নির্মমভাবে নিহত হওয়ার সময়ে তাঁর দুই কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা প্রবাসে থাকায় ঘাতকদের নির্মমতার হাত থেকে রেহাই পান।

বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, মানব কল্যাণ, জনগণের প্রয়োজনের সময়ে সাড়া দেওয়া, জনগণের চাওয়া-পাওয়া, আশা-আকাঙ্ক্ষা বুঝতে পারা, জনগণের মধ্যে আত্মনিবেদিত কাজ, আধুনিকতা, বিজ্ঞানমনস্কতা এবং অগ্রসর চিন্তা চেতনাই হচ্ছে আওয়ামী লীগের প্রাণশক্তি। বাংলাদেশের হৃদয় থেকে উৎসারিত এই প্রাণশক্তিই আওয়ামী লীগকে জন্মলগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত এদেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দলের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত রেখেছে। ঐতিহাসিক প্রয়োজনে জনগণের ভেতর থেকে গড়ে উঠেছে জনগণের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান আওয়ামী লীগ। যার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির ভূখণ্ডের সীমানা পেরিয়ে এই উপমহাদেশের অন্যতম বৃহৎ এবং জনসমর্থনপুষ্ট অসামপ্রদায়িক, প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক, মানব কল্যাণকামী রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ তার পরিচিতি অর্জনে সক্ষম হয়েছে।

এক কথায় বলতে গেলে পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিন্ন করে হাজার বছরের কাঙ্ক্ষিত বাঙালি জাতির স্বাধীনতা লাভসহ সকল মহতী অর্জনের নেতৃত্বে ছিল জনগণের প্রাণপ্রিয় সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ; যার মহানায়ক ছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আজ তাঁরই সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা বাঙালি জাতির সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ রচনার আলোকোজ্জ্বল পথ তথা আর্থ-সামাজিক-সার্বিক মুক্তির লক্ষে কাজ করে চলেছেন।

লেখক পরিচিতি: বিশিষ্ট কলামিস্ট, গবেষক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ,সাধারন সম্পাদকঃ জাপান আওয়ামীলীগ।সভাপতিঃ বঙ্গবন্ধু পেশাজীবী পরিষদ,জাপান শাখা।

Comments are closed.

More News Of This Category