শনিবার, ২০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

লাইলাতুল কদর : পূর্ণময় রজনী

মাওলানা হাসনাইন হাফিজ


প্রেম ও পুণ্যময় এক রাত লাইলাতুল কদর। শবে কদর বলেও এর প্রসিদ্ধ রয়েছে। আল্লাহ তায়ালার কাছে এ রাতটির মর্যাদা অনেক বেশি। মুসলমানরা জাগতিক কোলাহল থেক মুক্ত হয়ে ইতেকাফ করে থাকেন এ রাতটির মর্যাদা ও ফজিলত পাওয়ার আশায়। নিজেকে প্রকৃত মানুষরূপে, সমাজকে আদর্শ সমাজ হিসেবে এবং রাষ্ট্রকে অন্যায় অনাচারের পথ থেকে মুক্ত করতে রমজানের যেরূপ গুরুত্ব রয়েছে, রমজানে লাইলাতুল কদর নসিব হওয়ারও তেমনি গুরুত্বপূর্ণ। এ সৌভাগ্য কেবল আখেরি নবীর (সা.) উম্মতের জন্যই নির্দিষ্ট। সে মহান রাতের ইবাদত অন্যান্য সময়ের হাজার মাস ইবাদতের চেয়েও উত্তম। এ সম্পর্কে কোরআনে এসেছে, ‘কদরের রাত হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম।’ (সুরা কদর : ৩)

পবিত্র কোরআনের এ আয়াত প্রমাণ করে কদরের রাতে ইবাদত করা কেবল হাজার মাসের ইবাদতের সমানই নয় বরং তার চেয়েও শ্রেষ্ঠ। এই শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদার মাপকাঠি কিংবা হাজার মাসের ইবাদতের চেয়ে আরও কতো মাস, কতো দিনের সমান বা বেশি তা আমাদের জানা নেই। মুফাসরিগণ মনে করেন, আল্লাহ তায়ালা ‘হাজার মাস’ দ্বারা সুদীর্ঘ সময় কিংবা অনির্দিষ্টকাল সময় বুঝিয়েছেন। এ রাতের মর্যাদা যে কতো বেশি তা  বোঝাতেই হাজার মাসের কথা বলা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালার এ বাণীই প্রমাণ করে এ রাতের মর্যাদার শেষ নেই, অসীম মর্যাদায় পরিপূর্ণ এ রাতের ইবাদত।
মহিমান্বিত এ রাতটি আমাদের ভাগ্যে এমনিতেই জুটে যায়নি। এর  ইতিহাস রয়েছে, রয়েছে নানা বর্ণনা ও অভিমত। লাইলাতুল কদরের মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের ব্যাপারে হাদিস শরিফেও অনেক কারণ উল্লেখ আছে। তন্মধ্যে এখানে প্রসিদ্ধ দুটি কারণ তুলে ধরব। হাদিসের প্রসিদ্ধ কিতাব মুয়াত্তা-ই ইমাম মালেকে বর্ণিত আছে, হজরত রাসুলুল্লাহ জানতে পারলেন আগের উম্মতের বয়স অনেক দীর্ঘ হতো এবং সে তুলনায় তার নিজের উম্মতের বয়স অনেক কম। সুতরাং তার উম্মতের আমলের পরিমাণও হায়াতের ব্যবধানে কম হতে বাধ্য। এ ব্যাপারটি নিয়ে নবী করিম (সা.) ব্যথিত হলে আল্লাহ তায়ালা তার দুঃখ লাঘবের জন্য এ মহান রাত প্রদান করেন। অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘নবী করিম (সা.) বনি ইসরাইলের চার মহান ব্যক্তি হজরত আইয়ুব (আ.), হজরত জাকারিয়া (আ.) হজরত হিজকিল (আ.) ও হজরত ইউশার (আ.) আলোচনা করে বললেন, এদের প্রত্যেকেই আশি বছর করে আল্লাহর ইবাদতে নিমগ্ন ছিলেন, এমনকি চোখের পলক পরিমাণ সময়ও কেউ নাফরমানি করেননি। এতে সাহাবায়ে কেরাম আবেগাপ্লুত হয়ে যান। এ অবস্থায় হজরত জিবরাইল (আ.) নবীর (সা.) খিদমতে হাজির হয়ে সুরা কদর শুনিয়ে দিলেন। অবশেষে পুলকিত হৃদয়ে মহানবীর (সা.) পবিত্র জবান মোবারকেই এ বাণী উচ্চারিত হয়েছে যে, ‘আল্লাহ তায়ালা আমার উম্মতকে শবে কদর দান করেছেন। যা পূর্ববর্তী উম্মতরা পায়নি।’ (দুররে মানসুর)
কোরআন-সুন্নাহর এসব ফজিলতের কথা শুনে মুমিনমাত্রই লাইলাতুল কদরে ইবাদতের আগ্রহ পোষণ করে থাকে। তবে এ পুণ্যময় রজনী কোনটি? হাদিসে এসেছে, হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) রমজানের শেষ দশদিন ইতেকাফ করতেন এবং বলতেন, তোমরা রমজানের শেষ দশ রাতে শবে কদর সন্ধান কর।’ (বুখারি ও মুসলিম) অন্য হাদিসে এসেছে, ‘রমজানের শেষ দশকে বেজোড় রাতগুলোতে তোমরা শবে কদর তালাশ কর।’ (বুখারি) হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী রমজানের ২১, ২৩, ২৫, ২৭ ও ২৯ তারিখের যেকোনো রাতেই লাইলাতুল কদর থাকতে পারে। যদিও কেউ কেউ ২৭ তারিখের কথা বলেন।
এ লাইলাতুল কদর প্রেম-পূণ্যে ভরা শ্রেষ্ঠ একটি রজনী। মহানবী (সা.) জান্নাতের দরজা খোলা ও জাহান্নামের আগুন হারাম হয়ে যাওয়ার মতো তাৎপর্যপূর্ণ বাণী পেশ করেছেন এ রাতকে কেন্দ্র করে। তিনি বলেছেন, তোমরা তোমাদের কবরকে আলোকিত পেতে চাইলে এ রাতে ইবাদতের মাত্রা বাড়িয়ে দাও। এ রাতের ইবাদত হিসেবে কোরআন তেলাওয়াতকে প্রাধান্য দেওয়া যায়। কেননা পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘রমজান ওই মাস যে মাসে কোরআন নাজিল করা হয়েছে, যা মানুষের জন্য পুরোটাই হেদায়াত।’ (সুরা বাকারা : ১৮৫) অতএব, কোরআন নাজিলের মাসে কোরআনের অনুশীলনই হোক প্রধান ইবাদত। কোরআনের আদেশ নিষেধ তথা কোরআনের শিক্ষাকে মুমিনের জীবনে বাস্তবায়িত করার রমজানই মোক্ষম সময়। নফল নামাজও এ রাতের অন্যতম একটি ইবাদত হতে পারে। রাত্রি জাগরণ আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের বৈশিষ্ট্য। কোরআনে এসেছে, ‘তারা রাত্রি জাগরণ করে রবের উদ্দেশ্যে সিজদাবনত হয়ে ও দাঁড়িয়ে।’ (সুরা ফুরকান : ৬৪)
হাদিসেও এসেছে, ‘নবী করিম (সা.) বলেছেন, কদরের রাত রমজানের শেষ দশকে রয়েছে। যে ব্যক্তি এ রাতের মর্যাদা লাভের উদ্দেশ্যে দাঁড়িয়ে থাকবে আল্লাহ তার পূর্বাপর সব গোনাহ মাফ করে দেবেন।’ (মুসনাদে আহমদ)
এ মাসে ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে আল্লাহ ও বান্দার মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক সুনিবিড় হয়। অবারিত বরকত ও মাগফিরাত প্রাপ্তির মাধ্যমে নিজেকে আল্লাহর প্রিয় পাত্ররূপে পরিগণিত করা যায়। হজরত আয়েশা (রা.) রাসুলুল্লাহকে (সা.) আরজ করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! আপনি আমাকে বলে দিন কদরের রাত কোনটি? তা যদি আমি জানতে পারি তবে আমি কী করব? তিনি বললেন, তুমি বলবে, ‘আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুব্বুন, তুহিব্বল আফওয়া ফা’ফু আন্নি’। অর্থাৎ ‘হে আল্লাহ! নিশ্চয়ই তুমি ক্ষমাশীল, তুমি ক্ষমা করাকে পছন্দ কর, অতএব আমাকে ক্ষমা কর।’ (তিরমিজি)
লাইলাতুল কদরের এসব ফজিলত পেতে হলে আল্লাহর সঙ্গে বান্দার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। বেশি বেশি কোরআন তেলাওয়াত, নফল নামাজ, জিকির-আজকার ও তওবা-ইস্তিগফারের মাধ্যমে তার সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। যে সম্পর্ক ইহকালীন ও পরকালীন কল্যাণের পাথেয়।

আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে তার মাগফিরাত ও সান্নিধ্য লাভে ধন্য করুন।

লেখক : আলেম ও সাংবাদিক

Comments are closed.

More News Of This Category