চাঁদপুর প্রতিনিধি
চাঁদপুরের শাহরাস্তিতে পেনশনের ১৫ লাখ টাকাসহ স্বামীর বসত ভিটা ফেরৎ পেতে আদালতে পুত্র ও পুত্রবধূর বিরুদ্ধে মামলা করেছে ফুল নাহার নামের ৬৫ বছর বয়সী এক অন্ধ মা।
ঘটনাটি ঘটে শাহরাস্তি উপজেলার শ্রীপুর শেখ বাড়িতে।
মামলা সূত্রে জানা গেছে, মামলার বিবাদী শেখ মোঃ মনিরুজ্জামান রাজন (৪৫)ও তাঁর স্ত্রী লতা সরকার (৪০) মামলার বাদিনী ফুল নাহার (৬৫) ।বাদিনী ফুল নাহারের প্রথম স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি এখন দ্বিতীয় স্বামীর ঘরে বসবাস করছেন।বিবাদী শেখ মনিরিজ্জামান রাজন ফুল নাহারের প্রথম স্বামীর ঔরসজাত সন্তান। ফুল নাহার ২০১৯ সালে পরিবার কল্যান সহকারীর চাকুরী থেকে অবসর গ্রহণ করেন। অবসরের পর তিনি এককালীন পনেরো লাখ টাকা পান। মনিরুজ্জামান রাজন সেই পনেরো লাখ টাকা তাঁর মা ফুল নাহারের কাছ থেকে নিয়ে ফুলনাহারের স্বামীর সম্পত্তিতে পাকা ইমারত নির্মাণ করে ভাড়া দেয়। পনেরো লাখ টাকা সন্তান তাঁর মাকে ফেরত দেয়ার কথা থাকলে ফুল নাহার সে টাকা আর ফেরত পাননি। এমনকি প্রতি মাসে নানান অযুহাতে ফুল নাহারের পেনশনের টাকা প্রতি মাসে নিয়ে যেতেন মনিরুজ্জামান রাজন।
২০২৩ সালের ২৭ আগষ্ট বিবাদীগন ফুল নাহারকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে চিতোষী সাব রেজিষ্ট্রি অফিসে নিয়ে যায়। সেখানে বাদিনীকে ভয়ভীতি দেখিয়ে দলিলে টিপসই নেয়। এমনকি ফুল নাহারের সম্পত্তি রেজিষ্ট্রি করে নেয়ার বিষয়টি যাতে প্রকাশ না পায় সেজন্য তাঁকে ভয়ভীতি প্রদর্শন করে বাসা থেকে বের হতে না দিয়ে খাওয়া দাওয়ায় কষ্ট দিতে থাকে। বিষয়টি বাদিনী এক নং স্বাক্ষী শেখ আনিছকে জানানোর পর বিবাদীগণ ফুল নাহারকে মারধর করে।বিবাদীগণ ফুল নাহারকে একটি কক্ষে রেখে নিজ নজরদারিতে রাখে। রমজানের ইদের পর রাতে বিবাদীগণ ফুল নাহারকে বাসা থেকে বের করে দিলে লোকমারপত খবর পেয়ে এক নং স্বাক্ষী ফুল নাহারের অপর সন্তান শেখ আনিস ফুল নাহারকে নিজের বাসায় নিয়ে আসে।এ ঘটনায় এলাকায় চরম অসন্তোস দেখা দেয়।
মামলা সূত্রে আরও জানা গেছে, বিবাদীগণ মাটি মাটার শ্রমিক নিয়ে দ্বিতীয় ঘটনাস্থল শ্রীপুর গ্রামের শেখ বাড়িতে মাটি কেটে ভিটি প্রস্তুত শুরু করলে বাদিনী ফুল নাহার সেখানে বাধা দেয়। এতে বিবাদী মনিরুজ্জামান তাঁর স্ত্রী লতা সরকারের কথায় স্বাক্ষী শেখ আনিসকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে। এতে আনিস প্রতিবাদ করলে মনিরুজ্জামানের স্ত্রী লতা সরকার আনিসকে জুতা দিয়া পিটাইয়া জনসম্মুখে হেয়প্রতিপন্ন করে। এমনকি আনিসের অন্ডোকোষ টিপিয়া ধরে মারাত্মক ব্যথা জখম করে। এরই মধ্যে ধুরন্দর লতা সরকার নিজের অপকর্ম আড়াল করতে জরুরী সেবা ৯৯৯ এ কল করে। খবর পেয়ে শাহরাস্তি থানার এস আই আনোয়ার হোসেন ঘটনাস্থলে এসে লোকজনের কাজ থেকে ফুল নাহারের ভালো আচরণের কথা শুনে দুই নং বিবাদী লতা সরকারকে তিরস্কার করে। লতা সরকার এস আই আনোয়ার হোসেনের উপস্থিতিতে তাঁর শ্বাশুড়ি ফুল নাহারকে লাথি মারতে গেলে এস আই নিবৃত্ত করেন তাঁকে। এমনকি লতা সরকার প্রকাশ্যে হুমকি দেন ফুল নাহারের অপর পূত্র এক নং স্বাক্ষী শেখ আনিসকে নারী নির্যাতন মামলা দিয়ে জেলের ভাত খাওয়াবেন। এমনকি লতা সরকারের বিরুদ্ধে কোনও শালিস দরবার বসালে কিংবা মামলা মোকদ্দমা করলে লতা সরকার শেখ আনিসকে ভাড়াটিয়া খুনি দিয়ে হত্যার হুমকি দেয়। বিবাদী শেখ মনিরুজ্জামান রাজন তাঁর মা ফুল নাহারকে ভরণ পোষণ চিকিৎসার খরচ না দিয়ে গালমন্দ করে। যার প্রতিকার পেতেই ফুল নাহার আদালতে মামলা করেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে,ছেলে ও ছেলের বউয়ের অবহেলা-অনাদরে অন্ধ মা ফুল নাহার বেশ অসহায় অবস্থায় তার দ্বিতীয় স্বামীর ঔরসজাত মেয়ে আমেনা বেগমের মেহের কালীবাড়িস্থ বাসায় অসহায় অবস্থায় দিনাতিপাত করছেন।
ফুল নাহার জানান, ’আমার বড় ছেলে শেখ মোঃ মনিরুজ্জামান (রাজন) এবং তার বউ লতা সরকার অত্যন্ত দুষ্ট ও দুর্দান্ত প্রকৃতির লোক। তারা আমাকে শারীরিক, মানসিকভাবে নির্যাতন করতো।এখন ভরণ-পোষণ দেয় না। যখন তখন তারা আমার গায়ে হাত তুলতো । আমি বেঁচে থাকি এটা তারা চায়না। আমি মারা গেলে তাদের হয়তোবা কোন সুবিধা হবে। তারা (আমার বড় ছেলে ও তার বউ) দেশীয় শালিশ দরবার কিছুই মানে না। সর্বশেষ আমি বড় ছেলে এবং তার বউ (লতা সরকার) -এর অত্যাচার আর সহ্য করতে না পেরে আদালতে মামলা করি।
বিজ্ঞ বিচারক আমলী আদালত, শাহরাস্তি, চাঁদপুর কোর্টে মামলাটি করা হয়। যার মামলা নম্বর- সি,আরঃ ১৭৭/২০২৪ ইং, দঃবিঃ ৩২৩/৩০৭/৩৫৫/৫০৬(২) ধারা তৎসহ পিতা-মাতার ভরণ পোষণ আইনের ৫(১)(২) ।
ফুল নাহার আরও বলেন, আমার বড় ছেলে শেখ মোঃ মনিরুজ্জামান (রাজন) এবং তার বউ লতা সরকারের অবহেলা অনাদরে আমি আজ চোখ থেকেও অন্ধ। বিগত ২০২১ সালে আমার চোখে সমস্যা দেখা দেয়। কিন্তু আমার পেনশনের ১৫ লক্ষ টাকা ছেলে ও ছেলের বউ এর নিকট থাকা সত্বেও তারা আমার চিকিৎসা করায়নি। তাদের চলছাতুরীর কারনে আজ আমি চোখ থেকেও অন্ধ। যথা সময়ে আমার চোখের চিকিৎসা করানো হলে আমার আর অন্ধত্ব বরণ করতে হতোনা। আমি এর দৃষ্টান্তমূলক বিচার রাষ্ট্র ও তথা সমাজের নিকট আশা করি ।
জানা গেছে,ফুল নাহারের বাবার বাড়ি শাহরাস্তি উপজেলার মেহার উত্তর ইউনিয়নের বানিয়া চো (মৃধাবাড়ী) গ্ৰামে। তার বাবার নাম মৃত্যু কলিম উল্লাহ ও মা’য়ের নাম ফাতেমা বেগম। তিনি (ফুল নাহার) ১৯৭৮ সালে শাহরাস্তি উপজেলায় উপ-স্বাস্থ্য কর্মী হিসাবে চাকুরীতে যোগদান করেন।
১৯৮০ সালে তিনি পারিবারিক আয়োজনে ২০ বছর বয়সে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তার প্রথম স্বামী নিজমেহার গ্রামের মৃতঃ শেখ শহিদুল হক।
প্রথম বিয়ের পর ফুল নাহারের জীবন ভালোই কাটছিলো। ইতিমধ্যে তার কোল জুড়ে আসে ২ ছেলে ও ১ মেয়ে। প্রথম স্বামীর ঘরের তিন সন্তান হচ্ছে যথাক্রমে (১) শেখ মোঃ মনিরুজ্জামান (৪৫)রাজন, (২) শেখ আনিছ (৪২) ও মেয়ে (৩) সানজিদা খানম (৩৯) কিন্তু তার সেই সুখ বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। এক অজানা রোগে বিয়ের মাত্র ৯ বছরের মাথায় তার প্রথম স্বামী শেখ শহিদুল হক মৃত্যুবরণ করেন। ২৯ বছর বয়সে স্বামী হারা হন ফুল নাহার। এসময় তিনি ছোট্ট ছোট্ট ৩ শিশু সন্তানকে নিয়ে অথৈই জলে ভাসতে থাকেন। একদিকে চাকুরি অপরদিকে তিন শিশু সন্তানকে লালন-পালন করে বড় করা তার জন্য ছিলো সত্যি এক কঠিন চ্যালেঞ্জ। স্বামীর মৃত্যুর পর তার চারিদিকে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। এসময় ফুল নাহার অসহায় হয়ে পড়েন। প্রথম স্বামীর মৃত্যুর পর পারিবারিক চাপে ও ৩ শিশু সন্তানকে পড়া-লেখা করিয়ে মানুষের মত মানুষ করার জন্য এবং সংসারে সুখের কথা বিবেচনায় করে ফুল নাহার ১৯৯৪ সালে প্রথম স্বামীর মৃত্যুর ৬ বছরের মাথায় ২য় বার বিয়ের পিড়িতে বসেন। তার দ্বিতীয় স্বামীর নাম মোঃ আবুল হোসেন।
দ্বিতীয় বিয়ের পর ফুল নাহার প্রথম স্বামীর রেখে যাওয়া তিন শিশু সন্তানকে নিয়ে প্রথম স্বামীর রেখে যাওয়া বাড়িতে বসবাস শুরু করেন। এ সময় দ্বিতীয় স্বামী মোঃ আবুল হোসেন শাহরাস্তি মডেল থানায় কর্মরত ছিলেন। দ্বিতীয় স্বামীর ঘরেও ফুল নাহারের ২ ছেলে ও ১ মেয়ে সন্তান রয়েছে।
দীর্ঘ ৩৬ বছর চাকরি শেষে তিনি ২০১৯ সালে সরকারি নিয়ম অনুযায়ী অবসরে আসেন। অবসরে আসা কালে তিনি ১৫ লাখ টাকা এককালীন পেনশনের টাকা পান যা তিনি তার বড় ছেলে শেখ মোঃ মনিরুজ্জামানের (রাজন) ও তার বউ লতা সরকার বিভিন্নভাবে প্রলোভন ও প্রতারণা করে হাতিয়ে নেয়ায় অভিযোগে তিনি আদালতে মামলা করেন