শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১৩ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বিদ্যালয়ে না গিয়েই বেতন নেন শিক্ষকরা!

পপেন ত্রিপুরা,খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি []বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সরকারিভাবে নিয়োজিত শিক্ষকরা কখনো বিদ্যালয়ে যাননি। এখনো যান না। পাঠদান করেননি কখনো। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে পরিচয় ঘটে না কখনো। কোনো কোনো শিক্ষক তার কর্মস্থল বিদ্যালয়ের চেহারাও দেখেননি। কিন্তু বছরের পর বছর বাড়িতে বসে বেতন উত্তোলন করে থাকেন শিক্ষকরা।
রাঙামাটি পার্বত্য জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ঘুরে দেখা গেছে এসব চিত্র।

সাজেক ইউনিয়নের এরকম একাধিক বিদ্যালয়ের মধ্যে দেখা যায়, শিয়ালদাইলুই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়(স্থাপিত ১৯৬২), বেটলিং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়(স্থাপিত ১৯৬৩) ও তুইচুই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়(স্থাপিত ১৯৬৫)। এই তিনটি বিদ্যালয়ে প্রত্যেকটিতে তিনজন করে শিক্ষক নিয়োগ করা আছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই তিনটি বিদ্যালয়ে কখনো শিক্ষকরা যান না। বিদ্যালয়টি চলছে, বর্গা শিক্ষক দিয়ে। এক থেকে দুইজন বর্গা শিক্ষক দিয়েই প্রায় ৬০ বছর কেটে গেছে এইসব বিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম।
সরকারিভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষক স্কুলে না গিয়ে সেখানকার পঞ্চম শ্রেণি পাশ বা আন্ডার মেট্রিক লোক দিয়ে স্কুলে পাঠদান করানো হয়। বিনিময়ে সেই বর্গা শিক্ষক পান মাসে দুই থেকে তিন হাজার টাকা। এবং শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে পান প্রতি মাসে এক কেজি চাল। প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণবিহীন এবং পঞ্চম, অষ্টম শ্রেণি পাশ বা নন-মেট্রিক লোক দিয়ে চলছে শিক্ষার ভিত প্রাথমিক শিক্ষার কার্যক্রম। বিষয়টি সবার অগোচরে রয়েছে এমনটাও নয়। উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা থেকে শুরু করে পার্বত্য জেলা পরিষদ কর্তৃপক্ষও এ ব্যাপারে অবগত রয়েছে।
এ ব্যাপারে মুঠোফোনে  শিয়ালদাইলুই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জয়ন্ত চাকমার সাথে রিপোর্টার পরিচয় দিয়ে তাকে প্রশ্ন করা হয়, তিনি বিদ্যালয়ে যান কি না। প্রশ্ন শুনে জয়ন্ত চাকমা হুট করে ক্ষেপে যান। ভাঙ্গা বাংলায় বলেন, আমি স্কুলে যাই বা না যাই সেটা আমি বুঝবো আর অফিস বুঝবে। আপনার মাথা ঘামানোর দরকার নেই। তাকে ফের প্রশ্ন করা হলে এক পর্যায়ে উল্টো প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন জয়ন্ত চাকমা। জিজ্ঞাসা করেন, আপনি কখন গেছিলেন শিয়ালদাইলুই? এলাকার মানুষ, হেডম্যান, ম্যানেজিং কমিটির মানুষরা আমাকে কেউ কিছু বলে না, কেউ অভিযোগ করে না, আপনি কীভাবে জানলেন?
বারবার প্রশ্ন করার ফলে এক পর্যায়ে তিনি জানান, মাঝে মাঝে যান তিনি। তাকে অধিকাংশ সময় অফিসের কাজে যেতে হয়। তার সহকারি শিক্ষকরা যায় কিনা জানতে চাইলে জানান, তারাও মাঝেমাঝে যান। বক্তব্যে যোগ করেন, সেখানে অবস্থান করে স্কুল চালানো সম্ভব না। সেখানে সেরকম কোনো পরিবেশ নেই।

এ ব্যাপারে, ত্রিপুরা স্টুডেন্টস ফোরাম, বাংলাদেশ বাঘাইছড়ি উপজেলা শাখার সভাপতি বিনয় ত্রিপুরা জানান, বিদ্যালয়ে শিক্ষাকরা না গিয়ে বর্গা শিক্ষক দিয়ে পাঠাদান করানো ব্যাপারটি সবাই জানে। এটা অনেকটা ওপেন-সিক্রেট ব্যাপার। উপজেলা শিক্ষা অফিসার থেকে জেলা পরিষদ সবার অবগত রয়েছে।

এ ব্যাপারে, বাঘাইছড়ি উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা জয়নাল আবেদীন মুঠোফোনে বলেন,

ক্রাইম রিপোর্টকে বলেন ‘আমি এখানে নতুন এসেছি। বিষয়টি আমি জানতাম না, কিছুদিন আগে টিএসএফ’র ম্যাগাজিনে প্রকাশিত একটি আর্টিক্যাল থেকে জেনেছি। এ ব্যাপারে আজকে(২৯ এপ্রিল, ২০১৯) একটা জরুরী মিটিং করা হয়েছে।’ শিক্ষা কর্মকর্তা জানান, গ্রীষ্মের ছুটির পর উপজেলা নির্বাহী অফিসারের নেতৃত্বে বিদ্যালয় পরিদর্শন করে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি বলেন, যার চাকরি করার ইচ্ছা থাকবে, সেই শিক্ষককে যার যার বিদ্যালয়ে অবস্থান করে পাঠদান করতে হবে। অন্যথায় সোজা এ্যাকশান নেয়া হবে।

জয়নাল আবেদীন জেএসএস-ইউপিডিএফকে ইঙ্গিত করে জানান, জঙ্গলের বিশেষ একটি গ্রুপের ভয়ে শিক্ষকরা বিদ্যালয় এলাকায় এলাকায় অবস্থান করতে পারেন না, এই জাতীয় অভিযোগ তার কাছে রয়েছে।

তবে, শিক্ষা কর্মকর্তার এই অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে দাবি করেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অভিভাবক ও একজন বর্গা শিক্ষক। তাদের মন্তব্য, অন্তত শিক্ষা উন্নয়নে কোনো রাজনৈতিক দল বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। বরং শিক্ষকরাই সরকার দলীয় ক্ষমতাকে অপব্যবহার করে বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থেকেছেন আজীবন। শিক্ষকদের বিরুদ্ধে কোথাও অভিযোগ করে ফলপ্রসূ হয় না বলেও তারা অভিযোগ করেছেন।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, সেসব স্কুলে বদলী হওয়া শিক্ষকরা যোগদান করার পর প্রথম একবার গিয়ে পরিদর্শন করে আসেন। এই পরিদর্শনে তারা ম্যানেজিং কমিটি আর বর্গা শিক্ষকদের সাথে কথা বলে সবকিছু পাকাপোক্ত করে আসেন।

তাদের পূর্বে যেসব শিক্ষকরা বর্গা শিক্ষকদের যা দিতেন তারাও অনুরূপ দিয়ে থাকেন, তাদের সাথে যোগাযোগ রাখেন। কোনো কোনো শিক্ষক একবারের জন্যও বিদ্যালয় দৰ্শন করেননি বলে জানা গেছে। বিদ্যালয়ের দরজা-জানালা কয়টা, কয়টা কক্ষ এবং বিদ্যালয়টি পাকা নাকি কাঁচা তাও বলতে পারেন না। প্রতিবার নতুন বছরে নতুন পাঠ্যপুস্তকসহ অন্যান্য শিক্ষা সামগ্রিও বর্গা শিক্ষকরাই নিয়ে যান স্কুলে। সরকারি শিক্ষকরা কেবল শিক্ষা অফিস থেকে সংগ্রহ করে থাকেন। বিদ্যালয় মেরামত, আসবাবপত্র ক্রয় করার জন্য সরকার বিভিন্ন প্রকল্প দিলেও সাজেকের এই স্কুলগুলোতে নথিপত্র সংরক্ষণ করার মত কোনো আলমারি নেই বলে জানা যায়। বর্গা শিক্ষকগণ শিক্ষার্থী হাজিরা খাতাসহ বিভিন্ন কাগজপত্র সংরক্ষণ করেন তাদের বাড়িতে।

শিক্ষক হাজিরা খাতা থাকে বিদ্যালয়ে না যাওয়া সেইসব সরকারি শিক্ষকদের হাতে। বিদ্যালয়ের মাসিক-ত্রৈমাসিক প্রতিবেদন বছরের শুরুতে একবারই সব ক’টা তৈরী করে তাতে অগ্রিম স্বাক্ষর নেয়া হয় ম্যানেজিং কমিটির সভাপতির। এই তিনটি বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতিরা থাকেন স্কুল ক্যাচমেন্টের বাইরের এলাকায়। এমনকি সাজেক ও জেলার বাইরেও অবস্থান করছেন দীর্ঘ বছর ধরে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিনজনের মধ্যে একজন থাকেন রুইলুই পর্যটন এলাকায়, আরেকজন থাকেন বাঘাইছড়ি সদরে এবং তৃতীয়জন থাকেন খাগড়াছড়ির দীঘিনালায়। তিনজনের দুই সভাপতি একাধারে মৌজা প্রধানও(হেডম্যান)।

ম্যানেজিং কমিটির সভাপতিদের সাথে শিক্ষকদের রফাদফা হয় বলেও স্থানীয়দের অভিযোগ রয়েছে। শিক্ষকরা বিদ্যালয়ে যান না, এ বিষয়টি সভাপতিরাই বেশি ভাল করে জানেন। তবুও কেন তারা স্কুল ও স্কুলের শিক্ষা উন্নয়নের জন্য কোনো পদক্ষেপ নেননি। আবার কোনো কোনো সভাপতি এর আগে অলিখিত অভিযোগ করেও কোনো সুফল পাননি বলে জানা যায়। উল্টো তাদেরকে শিক্ষকদের পক্ষ থেকে হুঁশিয়ারি দেয়া হয়েছে। জানা যায়, শিক্ষকরা প্রায় সময় অদৃশ্য শক্তি ভাড়া করে থাকেন। মূলত এই কারণেই স্কুলের সচেতন অভিভাবকরা নিরবে মেনে নিয়েছেন।
যে বিদ্যালয়গুলোর কথা বলা হচ্ছে, সেইসব স্কুলগুলো অনেক দূরে পাহাড়ের গহীন অরণ্যে অবস্থিত। সেখানে গিয়ে কোনো শিক্ষকের পক্ষে স্কুল চালানো সম্ভব নয়! যাতায়াত ব্যবস্থা খুবই নাজুক। কোনো রাস্তাঘাট নেই। প্রতিদিন পায়ে হেঁটে সেখানে পৌঁছা কারোর পক্ষে সম্ভব না। একমাত্র উপায়, সেখানে অবস্থান করে পাঠদান করতে হবে।
এদিকে, দীঘিনালায় এরকম বেশ কয়েকটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে বলে জানা যায়। মেরুং ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডের বিষ্ণু কার্বারী পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও বোয়ালখালি ইউনিয়নের বব্রুবাহন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এই দুইটি বিদ্যালয়ও চলে বর্গা শিক্ষক দিয়ে।
যেসব বিদ্যালয়ে এই শিক্ষা সন্ত্রাস চলছে, সেসব বিদ্যালয় ক্যাচমেন্টের অভিভাবক, ম্যানেজিং কমিটির লোকজনের অভিযোগ করার মতো শক্তি-সামর্থ ও সাহস নেই। এর আগে যারা অভিযোগ করেছিল, তারা কোনো না কোনোভাবে, কারো না কারো দ্বারা চাপ প্রয়োগের শিকার হয়েছিল, নির্যাতনের শিকার হয়েছিল। এমনকি মৃত্যুর হুমকিও পেয়েছিল।

বেটলিং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়:
১৯৬৩ সালে স্থাপিত এই বিদ্যালয়ে বর্তমানে নিয়োগকৃত শিক্ষক আছেন তিনজন। প্রধান শিক্ষক রুপক চাকমা, সহকারি শিক্ষক ফুল কুমারী চাকমা ও সুমিতা চাকমা। কিন্তু স্কুল ও শিক্ষকদের মধ্যে কখনো পরিচয় ঘটেনি। এই তিনজন শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করছেন বর্গা শিক্ষক হরে বিকাশ ত্রিপুরা। তাকে প্রতিমাসে দেয়া হয় ৬,০০০ টাকা। তিনি এই স্কুলের একাধারে প্রধান শিক্ষক, সহকারি শিক্ষক সবকিছু। এই বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটির সভাপতি রথাল পাংখোয়া থাকেন রুইলুই পর্যটন এলাকায়। বিদ্যালয়ে বর্তমান অধ্যয়নরত ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ৯৩জন।

শিয়ালদাইলুই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়:
১৯৬২ সালে স্থাপিত এই বিদ্যালয়ে সরকারিভাবে নিয়োগকৃত শিক্ষক আছেন তিনজন। প্রধান শিক্ষক জয়ন্ত চাকমা, সহকারি শিক্ষক বশিউর রহমান ও সান্তা..(?)। সহকারি শিক্ষক সান্তা ম্যাডামের টাইটেল বর্গা শিক্ষক বা ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি কেউই নিশ্চিত করে বলতে পারেননি। বর্তমানে বর্গা শিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত আছেন, ধনেশ্বর ত্রিপুরা ও সোনালী ত্রিপুরা। তাদের জনপ্রতি বাত্সরিক বেতন ৩০ হাজার টাকা করে। বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি হেডম্যান যৌপৈথাং ত্রিপুরা থাকেন বাঘাইছড়ি উপজেলা সদরে। এ বিদ্যালয়ে বর্তমান শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫৫জন। শেষ প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় অংশগ্রহন করেছিল দুইজন। একজন বালক ও একজন বালিকা।

তুইচুই পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়:
১৯৬৫ সালে স্থাপিত এই বিদ্যালয়ে সরকারিভাবে নিয়োজিত শিক্ষক আছেন তিনজন। প্রধান শিক্ষক সুজিত দত্ত, সহকারি শিক্ষক সমর্পন চাকমা ও অজ্ঞাত(নারী শিক্ষক)। বর্গা শিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত আছেন, রহিত ত্রিপুরা ও জীবন ত্রিপুরা। বর্গা শিক্ষকদ্বয় মাসিক বেতন পান ৪,৫০০ টাকা করে। বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি হেডম্যান গরেন্দ্র লাল ত্রিপুরার স্থায়ী বাড়ি খাগড়াছড়ি-দীঘিনালা সড়কের ৯মাইল এলাকায়। এ বিদ্যালয়ে বর্তমান অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪৭জন।

এই তিনটি বিদ্যালয়ে প্রাক-প্রাথমিক ও প্রথম শ্রেণি শিক্ষার্থীদের পড়ানো হয়, আদি বাল্যশিক্ষা। সেখানে জাতীয় পাঠ্যপুস্তক পড়ানো হয় না। দুই বছর বাল্যশিক্ষা পড়ানোর পর সোজা দ্বিতীয় শ্রেণিতে উত্তীর্ণ করা হয়। এসব বিদ্যালয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন হয় না, গাওয়া হয় না জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’।
অভিযোগ রয়েছে, বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেশের নাভিমূল এবং সবচেয়ে আলোচিত পর্যটন এলাকা সাজেকের রুইলুই। যেখানে প্রতিদিন হাজার মানুষের আনাগোনা হয়। এখানে অবস্থিত রুইলুই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এ বিদ্যালয়ও চলে বর্গা শিক্ষক দিয়ে।

Comments are closed.

More News Of This Category