বেলায়েত সুমন
আলমগীর হোসেন শ্রাবণ। একজন ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য (মেম্বার)। গ্রামের মানুষের কাছে আলম নামেই পরিচিত তিনি। পেশায় একজন ব্যবসায়ী হলেও নেশায় একজন সমাজ সেবক। খুলনার রূপসা উপজেলার নৈহাটী গ্রামের এই তরুণ আলো ফুঁটবেই প্রকল্পের মাধ্যমে ইতোমধ্যে প্রশংসা কুড়িয়েছেন সমাজের বিভিন্ন মহলের মানুষের।
মানুষকে বই পড়ানোর বাসনা থেকে একটি লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন আলমগীর। কিন্তু লাইব্রেরিতে এসে বই পড়ার ইচ্ছা এবং সময় কোথায় গ্রামের মানুষদের? কিন্তু গ্রামের মানুষকে যে বই পড়াতেই হবে, জানাতে হবে দেশ, সমাজ, রাজনীতি, ধর্ম, দর্শন, পরিবার ইত্যাদি সম্পর্কে। তবে উপায় কোথায়? অবশেষে উপায় খুঁজে পেলেন আলমগীর। একটি ভ্যান ক্রয় করে সেখানে বিশেষ ব্যবস্থায় বই সাঁজিয়ে নিজেই ভ্যান নিয়ে নেমে পড়লেন গ্রামের রাস্তায়। ভ্রাম্যমান এ লাইব্রেরির নাম দেয়া হলো “আলো ফুঁটবেই”। ভ্যান ভর্তি বই নিয়ে নিজেই প্যাডেল চালিয়ে মানুষের দ্বারে দ্বারে পৌঁছে যান আলমগীর। একজন ইউপি সদস্যের ভ্যান চালানো প্রথমে অনেকে বাঁকা চোখে দেখলেও গ্রামের শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অনেকেই এখন এ লাইব্রেরির নিয়মিত পাঠক। প্রতি মাসে চার থেকে পাঁচশ বই পড়ানো হয় এ লাইব্রেরির মাধ্যমে।
গ্রামের ছোট্ট শিশুদের জন্য আলমগীর হোসেন গড়ে তুলেছেন আলো ফুটবেই বিদ্যালয়। তিন থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশুরা এ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। স্কুলটি অন্য স্কুলের থেকে ব্যতিক্রম। সকালবেলা স্কুলে আসার পর প্রথমেই ব্রাশ করানো হয় সকল শিশুকে। তারপর শুরু হয় পাঠদান তবে এখানে কোনো বই পড়ানো হয়না। সমাজের রীতি-নীতি, আদব-কায়দা ইত্যাদি শেখানো হয় এ স্কুলে। মূলত বইয়ের চাপ থেকে দূরে রেখে শিশুর মেধার বিকাশ সাধনই এ স্কুলের মূল উদ্যেশ্য।
সমাজের বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের জন্য আলমগীর প্রতিষ্ঠা করেছেন আলো ফুটবেই মোঃ সালেহীন প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় পরিচর্যা ও পুনর্বাসন কেন্দ্র। ৭৫ জন প্রতিবন্ধী শিশুকে নিয়ে স্কুলটি শুরু হলেও বর্তমানে সেখানে শিক্ষার্থী সংখ্যা ১৪০। প্রতিদিন পাঠদানের পাশাপাশি সপ্তাহে একদিন থেরাপির ব্যবস্থা এবং মাসে একটি মেডিকেল ক্যাম্প করা হয় বিদ্যালয়টিতে। এমনকি এসব শিশুদের ওষুধেরও ব্যবসা করে দেন আলমগীর হোসেন। পাশাপাশি দু’টি স্কুলে শিক্ষার্থীদের নিয়মিত খাবার প্রদান করা হয়।
স্কুল দু’টিতে ১৭ জন শিক্ষিকা নিয়মিত পাঠদান করেন। নারীরা মাতৃসুলভ আচরণের মাধ্যমে শিশুকে সুন্দরভাবে পাঠদান করাতে পারবেন ভেবে আলমগীর নারীদের মাধ্যমেই স্কুলের কার্যক্রম পরিচালনা করেন এবং নিজেই তাদের বেতনের ব্যবস্থা করেন।
গ্রামের নারীদের জন্য আলমগীরের রয়েছে বিশেষ উদ্যোগ। যুব উন্নয়ের সহযোগিতায় তিনবার বিভিন্ন বিষয়ের ৬০ জন নারীকে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন তিনি। একসময় অনেক নারী বিড়ি শিল্পের সাথে জড়িয়ে পড়লে আলমগীর তাদেরকে সেদিক থেকে ফিরিয়ে কুটির শিল্পের প্রতি আগ্রহী করে তোলেন। বর্তমানে নৈহাটী গ্রামের নারীরা খেজুর পাতা দিয়ে জুতা, ভ্যানিটি ব্যাগ তৈরী করে সপ্তাহে ৭০০ থেকে ১০০০ টাকা উপার্জন করছেন।
বয়স্ক নারীদের মাঝে শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতে শীঘ্রই আলমগীর হোসেন খুলছেন আলো ফুঁটবেই বয়স্ক নারী শিক্ষা কেন্দ্র। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে “জাগো প্রজন্ম, বাঁচাও প্রজন্ম” স্লোগানে বৃক্ষরোপণ কার্যক্রম পরিচালনা করছেন আলমগীর। ইতোমধ্যে দশ হাজারের বেশি গাছ রোপন করেছেন তিনি। রাস্তার দুপাশে বিলাতি গাব গাছ এবং বাড়িতে লাগানোর জন্য নারীদের দেয়া হয়েছে ফলজ, বনজ, ওষুধী গাছ যাতে নারীরা বাড়িতে সেগুলো লাগানোর পাশাপাশি পরিচর্যা করতে পারেন। তবে রাস্তার পাশে বিলাতি গাব গাছ লাগানোর কারন, গাছটি অনেক শক্ত, সহজে ভেঙ্গে পড়েনা এবং ফল দায়ক। আলমগীরের টার্গেট তিনি এককোটি গাছ লাগাবেন।
গ্রামের মানুষের সুপেয় পানি নিশ্চিতের জন্য আলমগীর নিজ খরচে গ্রামের মোড়ে মোড়ে ¯’াপন করেছেন পানির ড্রাম তরুণদের জন্য গড়েছেন আইটি ক্লাব। সময় পেলেই আলমগীর গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে উঠোন বৈঠকের মাধ্যমে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেন গ্রামের নারীদের সাথে। বাল্যবিবাহ, যৌতুক, নারীর স্বার্থ গ্রাম আদালত ইত্যাদি বিষয়ে সচেতনতা তৈরী করেন নারীদের মাঝে।
সমস্ত কার্যক্রম পরিচালনা করতে আলমগীরকে প্রতি মাসে লক্ষাধিক টাকা ব্যয় করতে হয়। নিজেই বহন করেন এ ব্যয়ভার। ব্যবসা থেকে প্রাপ্ত মুনাফার সম্পূর্ণটাই ব্যয় করেন এ কল্পগুলোর পেছনে। তবে আর্থিক সমস্যার কারণে মাঝে মাঝে হিমশিক খেতে হয় তাঁকে। ইতোমধ্যে আলমগীর হোসেনের কার্যক্রম প্রচার করেছে জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’। পেয়েছেন ডেইলি স্টারের পক্ষ থেকে সম্মাননা পুরস্কার ও হিরো অন দি হুইলস খেতাব। তাছাড়া বাংলাদেশের যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসও পুরস্কৃত করেছে আলমগীর হোসেনকে।
সমাজকে নিয়ে রয়েছে আলমগীর হোসেনের নানান পরিকল্পনা। ব্যক্তি উদ্যোগে মানষিক প্রতিবন্ধীদের জন্য প্রতিষ্ঠা করতে চান একটি পুনর্বাসন কেন্দ্র, তরুণদের জন্য ল্যাংগুয়েজ ক্লাব প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি মোবাইল আসক্তি কমানোর জন্য করতে চান বিশেষ কাউন্সিলিংয়ের ব্যবসা। প্রতিষ্ঠা করতে চান ট্যুরিস্ট ইনফরমেশন সেন্টার। ওয়ান ভিলেজ ওয়ান ফ্যামিলি প্রকল্প চালুর মাধ্যমে আলমগীর হোসেন স্বপ্ন দেখেন ক্ষুধা, নিরক্ষরমুক্ত আধুনিক একটি নৈহাট গ্রাম প্রতিষ্ঠার। যেখানে থাকবেনা দরিদ্রতা, মাদক, হানাহানি, কোন্দল; গ্রামের সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বসবাস করার মাধ্যমে তৈরী হবে একটি সংঘবদ্ধ পরিবার।