শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১৩ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

হাজীগঞ্জে জমি অধিগ্রহণের অর্থ পরিশোধ না করায়  সেতু নির্মাণ কাজে ধীরগতি

  • উপজেলা ও ইউনিয়ন সড়কে দীর্ঘ সেতু নির্মাণ প্রকল্প 

বিশেষ প্রতিবেদক 

চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে জমি অধিগ্রহনের অর্থ পরিশোধ না করায় বন্ধ হয়ে গেছে ইউনিয়ন সড়কে দীর্ঘ সেতু নির্মাণ প্রকল্পের ভায়াডাক্ট স্লাব ও এপ্রোচ সড়ক নির্মাণ কাজ। কার্যাদেশ অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও পাঁচ বছরেও শেষ হয়নি সেতু নির্মাণ কাজ।ফলে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে হাজীগঞ্জবাসীর স্বপ্নের সেতু নির্মাণ কাজের পরিকল্পনা।এতে অধিগ্রহনের অর্থ না পেয়ে ক্রমেই ক্ষুব্ধ হচ্ছেন জমির মালিকগণ।
সূত্রমতে,স্থানীয় সরকার বিভাগের আওতায় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন ‘উপজেলা ও ইউনিয়ন সড়কে দীর্ঘ সেতু নির্মাণ প্রকল্প (তৃতীয় সংশোধিত)’ প্রকল্পটি ‘এলবিসি’ প্রকল্প নামে পরিচিত।২০১০ সালের মার্চ মাসে ৬২৮ কোটি ১৫ লাখ টাকার এলবিসি প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন পায়।এই প্রকল্পটির কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিলো ২০১৩ সালের ডিসেম্বর মাসে। কিন্তু ছয়বার মেয়াদ বাড়ানোর পর আবারও  প্রকল্পের নতুন মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয় ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত। এরই মধ্যে নানান অনিয়ম আর দীর্ঘসূত্রিতায় প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২হাজার ২৮৮ কোটি টাকা।
দফায় দফায় প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি পেলেও সংশ্লিষ্ট সংস্থা কর্তৃক জমি অধিগ্রহনের অর্থ পরিশোধ না করায় বন্ধ হয়ে গেছে প্রকল্পের আওতাভুক্ত চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ উপজেলাধীন হাজীগঞ্জ-বড়কুল ফেরিঘাট বড়কুল পূর্ব ইউপি (কুমিল্লা-চাঁদপুর আরএন্ডএইচ টোরাগড় -সেন্দ্রা পালিশারা সড়কে ৮১০ মিটার চেইনেজে ২৫০ দশমিক ২০ মিটার দীর্ঘ পিসি গার্ডার সেতুর নির্মাণ কাজ।
অনুসন্ধানকালে জানা গেছে,২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সেতুটির নির্মাণ কাজ বাস্তবায়নের জন্য কার্যাদেশ দেয়া হয় ঢাকার পান্থপথের সুরমা আরবিএল (জেবি) নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে।প্যাকেজ ডব্লিউ ১৯৮ অনুযায়ী ২৫০ দশমিক ২০ মিটার সেতু নির্মাণের জন্য চুক্তিমূল্য ২২ কোটি ৫৯ লাখ ৪৮ হাজার ১৪ টাকার স্থলে ১৭ কোটি ১৪ লাখ টাকা (সংশোধিত)চুক্তি করা হয় প্রতিষ্ঠানটির সাথে।চুক্তি অনুযায়ী নির্ধারিত সময় ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠানটি কাজ শেষ করতে পারেনি।এমনকি সেতু তৈরিতে নিন্মমানের নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগও উঠে এই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে।সংশ্লিষ্টরা সেতু নির্মাণে প্রতিষ্ঠানটির কাজের অগ্রগতি কাগজে কলমে ৯৫ ভাগ দেখালেও পুরো সেতুতে এখনও সোলার লাইটের কোনো কাজই করেনি প্রতিষ্ঠানটি। অনুসন্ধানে এমন  তথ্য উঠে আসে।
অপরদিকে সেতুর দুই পাড়ে অবশিষ্ট কাজ করার জন্য প্যাকেজ ডব্লিউ ১৯৮ এ অনুযায়ী ভায়াডাক্ট স্লাব ও এপ্রোচ সড়কের কাজ করার জন্য চুক্তিমূল্য ১৯ কোটি ৯০ লাখ টাকার কার্যাদেশ দেয়া হয় হাজীগঞ্জের মেসার্স কোহিনুর এন্টারপ্রাইজ এন্ড আহসান হাবিব অরুন (জেবি) নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে।এই প্রতিষ্ঠানটি ২০২০ সালের অক্টোবর মাসে কাজ শুরু করে।চুক্তি অনুযায়ী ২০২১ সালের নভেম্বর মাসে প্রতিষ্ঠানটি মূল সেতুর দুই পাড়ে ২৭৭ দশমিক ১৫ মিটার ভায়াডাক্ট স্লাব ও ২৮৭দশমিক ৫৫ মিটার এপ্রোচ সড়ক তৈরির কথা থাকলেও জমি অধিগ্রহণের টাকা না পাওয়ায় স্থানীয় লোকজন টোরাগড় অংশের চলমান থাকা কাজ বন্ধ করে দেয়।সেতুর দক্ষিণ অংশ বড়কুল এলাকায় বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির কাজ চলমান রয়েছে।উত্তর অংশ টোরাগড় এলাকায়ও ৭৫ ভাগ সম্পন্ন হয়েছে।বর্তমানে জমি অধিগ্রহণের টাকা পরিশোধে বিলম্ব হওয়ায় সেতু নির্মাণ কাজে বিলম্ব হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সেতু এলাকায় দুই দশমিক ১৭ একর সম্পত্তি অধিগ্রহণ করা হয়।এর মধ্যে ১০৮ নং বড়কুল মৌজায় এক দশমিক ১০ একর ও ৮১ নং টোরাগড় মৌজায় এক দশমিক ৭ একর।অধিগ্রহণকৃত ভূমির প্রাক্কলন তৈরি করা হয় ১২ কোটি ৫৭ লাখ টাকা।পরিবর্তিতে জমি অধিগ্রহনের প্রাক্কলন বেড়ে দাঁড়ায় ১৫ কোটি ১৮ লাখ ১৫ হাজার ৬৪৫ টাকা।অভিযোগ রয়েছে, জমি অধিগ্রহনের সাথে সম্পৃক্ত সার্ভেয়ার শহিদুল ইসলাম এলাকার কতিপয় সুবিধাভোগী মানুষের সাথে আঁতাত করে ভূমি অধিগ্রহণে সরকারী অর্থ আত্মসাতের উদ্দেশ্যে অতিরিক্ত প্রাক্কলন তৈরি করেন।যদিও সার্ভেয়ার শহিদুল ইসলাম অভিযোগের সত্যতা নেই বলে এ প্রতিনিধিকে জানান।তবে তথ্য অনুসন্ধানকালে  চাঁদপুর ভূমি অধিগ্রহণ শাখায় ভুমি অধিগ্রহনের এল এ কেস ১১-২০২০-২১ ফাইলটি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বলে প্রতিনিধিকে তথ্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। পরে তথ্য অধিকার আইন অনুযায়ী তথ্য পাওয়ার যাবতীয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন শেষে এ প্রতিনিধি তথ্য সংগ্রহ করেন।
তথ্যমতে,জমি অধিগ্রহণের প্রাক্কলনকৃত ১২ কোটি ৫৭ লাখ টাকার মধ্যে ২০১৮ সালের জুন মাসে প্রথম কিস্তিতে ১২ কোটি টাকা এবং ২০২১ সালের নভেম্বর মাসে ৫৭ লাখ টাকা ডিপিপি সংস্থান (প্রজেক্ট ডেভেলপমেন্ট প্রপোজাল) অনুযায়ী চাঁদপুর জেলা প্রশাসক বরাবর অর্থছাড় করা হয়।২০২২ সালের জুন মাসে আবারও বাকি ২ কোটি ৬১ লাখ ১৫ হাজার ৬৪৫ টাকা ছাড় করার জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরে চিঠি প্রেরন করা হয় চাঁদপুর এল এ শাখা থেকে। বাকি অর্থ না পাওয়ার অজুহাতে এল এ শাখা থেকে জমির মালিকদের অধিগ্রহনের অর্থ পরিশোধ না করায় ক্ষিপ্ত হয়ে কাজ বন্ধ করে দেয় জমির মালিকরা।অপরদিকে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট প্রকল্প অফিস সেতু নির্মাণে মন্থর অগ্রগতি ও বিলম্বের কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছে “প্রকল্পের ডিপিপি অনুযায়ী ভূমি অধিগ্রহণে পর্যাপ্ত অর্থ না থাকায় কাজে বিলম্ব হয়। আন্তঃখাতে ডিপিপিতে জমি অধিগ্রহনে অবশিষ্ট যে অর্থের প্রস্তাব করা হয়েছে যা স্থানীয় সরকার বিভাগে প্রক্রিয়াধীন।”
অনুসন্ধানকালে জানা গেছে, ভূমি অধিগ্রহণের টাকা পরিশোধে দীর্ঘসূত্রতার নেপথ্যে রয়েছে ভূমি অধিগ্রহণে অনিয়মের অভিযোগ।এরমধ্যে রয়েছে অপ্রয়োজনীয় জমি অধিগ্রহণ,গাছপালার অস্বাভাবিক মূল্য নির্ধারণ,আঁতাত করে জমির মূল্য বেশি নির্ধারণ সহ নানান অসঙ্গতির অভিযোগ।যদিও সংশ্লিষ্টরা অস্বীকার করেছেন এসব অনিয়ম অসংগতির অভিযোগ।তবে তদন্ত হলে অধিগ্রহণ প্রক্রিয়ায় অনিয়ম অসংগতির থলের বিড়াল বেরিয়ে আসবে বলে অভিমত স্থানীয়দের।
জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়ার সাথে সম্পৃক্ত শহিদুল ইসলাম অনিয়মের কথা অস্বীকার করে এ প্রতিনিধিকে  বলেন, “প্রাক্কলন আমি তৈরি করিনি।আমি সার্ভে করেছি মাত্র।
এ বিষয়ে আপনি ডিসি স্যারের সাথে কথা বলতে পারেন।”
কবে নাগাদ জমি অধিগ্রহনের বাকি অর্থ পাওয়া যাবে তা কেউ বলতে না পারলেও চলতি বছরের ৩০ জুন প্রকল্পের কাজ শেষ করার জন্য চাঁদপুর জেলার নির্বাহী প্রকৌশলী ও হাজীগঞ্জ  উপজেলা প্রকৌশলীকে সেতুর সব কাজ ‘অবশ্যই সমাপ্ত করার’ কথা বলা হয়েছে সংশ্লিষ্ট স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর থেকে।

Comments are closed.

More News Of This Category