ক্রাইম রিপোর্ট ডেস্কঃ দেশে বর্তমানে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের জন্য বিনিয়োগকারীরা ব্যাংকের দিকে ঝুঁকছে। অথচ বিশ্বের কোথাও দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নে ব্যাংকনির্ভরতা নেই। সেখানে পুঁজিবাজারের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন হয়। আমাদের দেশেও পুঁজিবাজারের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন করতে হবে। এতে ব্যাংকনির্ভরতা কমার পাশাপাশি খেলাপি ঋণের ঝুঁকি থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন।
তিনি গত ৬ই এপ্রিল রাজধানীর শিল্পকলা একাডেমিতে ক্যাপিটাল মার্কেট এক্সপো-২০১৯-এর দ্বিতীয় দিনে ‘আর্থিক খাতের বর্তমান পরিস্থিতি ও মান উন্নয়নে করণীয়’ শীর্ষক সেমিনারে সভাপতির বক্তব্যে এসব কথা বলেন। সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের উপদেষ্টা এসকে সুর চৌধুরী। আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) পরিচালক শাহ মো. আহসান, ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরফান আলী, প্রাইম ব্যাংক ইনভেস্টমেন্টের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) তাবারক হোসেন ভূঁঞা এবং আইআইডিএফসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম সারওয়ার ভূইয়া। সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ইউসিবি ক্যাপিটালের হেড অব রিসার্চ রাজীব কুমার দাস।
সেমিনারে ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, ১৯৯২-৯৩ সালে সরকার বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের জন্য বাধ্য করেছিল। আর তা বিজ্ঞজনোচিত কাজ হয়নি। আমি সরকারকে অনুরোধ করব, এ ধরনের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে পুঁজিবাজার থেকে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের ব্যবস্থা করার জন্য। পুঁজিবাজারের উন্নয়নের জন্য বন্ড মার্কেটকে উন্নয়ন করতে হবে, করপোরেট বন্ডের বিষয়ে চিন্তা করতে হবে।
তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের অবদানের তেমন স্বীকৃতি দেয়া হয় না। এডি রেশিওর নিয়ম পালন করতে গিয়ে একসময় ব্যাংকগুলোর বাপদাদার নাম ভুলে যাওয়ার অবস্থা হতো। কিন্তু এখন এডি রেশিওর নিয়ম পরিপালন না করলেও কোনো সমস্যা হয় না। কিছুদিন আগে এডি রেশিও কমানো সত্ত্বেও ২৫টি ব্যাংক তা পরিপালনে ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি। এখানে তারা ব্যর্থ হয়েছে।
সঞ্চয়পত্রের বিষয়ে ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, দয়া করে সঞ্চয়পত্রের দিকে হাত দেবেন না। কারণ এটি দেশের লাখ লাখ মধ্যবিত্ত পরিবারের শেষ সম্বল। তারা এই সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে উপকৃত হয়।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাংকের ভূমিকা সম্পর্কে তিনি বলেন, অর্থনীতির উন্নয়নে ব্যাংক যেমন ভূমিকা রাখছে, অন্যদিকে এই খাতে কিছু সমস্যাও রয়েছে। আমাদের দেশের বেশির ভাগ আমানত স্বল্পমেয়াদে সংগ্রহ করে দীর্ঘমেয়াদে বিতরণ করা হয়। যা একটি দেশের অর্থনীতির জন্য খুবই আশঙ্কাজনক। এ ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে দীর্ঘমেয়াদি আমানত সংগ্রহে গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের উপদেষ্টা এসকে সুর চৌধুরী বলেন, একসময় ভুল ভাবা হতো যে পুঁজিবাজারের সঙ্গে মুদ্রাবাজারের কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু মুদ্রাবাজার ও পুঁজিবাজার একে অন্যের পরিপূরক। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে পুঁজিবাজারের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এ মুহূর্তে আর্থিক খাতের বেশির ভাগ অর্থ সরবরাহ করে ব্যাংক খাত। তাই ব্যাংকনির্ভরতা কমাতে পুঁজিবাজারকে শক্তিশালী করার বিকল্প নেই। পুঁজিবাজারকে শক্তিশালী করতে সরকার বা অন্য কোনো পক্ষ থেকে সুপারিশ না এলেও আমরা কিছু পদক্ষেপ নিয়েছি। আশা করি, এগুলো বাস্তবায়ন হলে তার ফলাফল পাবে জনগণ।
স্বল্পমেয়াদি আমানত সংগ্রহ করে দীর্ঘমেয়াদি খাতে বিনিয়োগ করাকে দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ জায়গা থেকে বেরিয়ে আসা দরকার। এর কারণে মাঝে মাঝে তারল্য সংকট দেখা দেয়। বন্ড মার্কেটের উন্নয়নে সরকারের উদ্যোগে একটি কমিটি করা হয়েছে। অচিরেই এর ফলাফল পাওয়া যাবে বলেও জানান তিনি।
প্যানেল আলোচনায় বিআইবিএমের পরিচালক শাহ মো. আহসান বলেন, আমাদের দেশের বেশির ভাগ ব্যাংক একই ব্যবসায়ীদের নিয়ে কাজ করে। ব্যাংকভিত্তিক গ্রহীতাদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। এ কারণেই বড় ঋণখেলাপির মতো সমস্যাগুলো তৈরি হচ্ছে। তাই খাতভিত্তিক ব্যাংকিং চালুর পরামর্শ দেন তিনি।
ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরফান আলী বলেন, আমরা যারা বিদেশীদের সঙ্গে ব্যবসা করি তাদের জন্য মূলধন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। একজন বড় গ্রাহক খেলাপিতে পরিণত হলে এর প্রভাব খুব বড়। তাই আমরা এজেন্ট ব্যাংকিংকে ছড়িয়ে দিতে গ্রামেগঞ্জেও কাজ করছি। এক্ষেত্রে ছোট গ্রাহকরা খেলাপি হলেও ব্যাংকের ওপর তেমন প্রভাব পড়ে না।
প্রাইম ব্যাংক ইনভেস্টমেন্টের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) তাবারক হোসেন ভূঁঞা পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশে বলেন, আর্থিক উন্নতি হলেও আমাদের দেশে সচেতনতা, শিক্ষা ও দক্ষতার অভাব রয়েছে। এ কারণে অনেক সময় বাজার ওঠানামা করতে দেখা যায়। দক্ষ নাগরিক গড়ে তুলতে পারলে এসব সমস্যার সমাধান করা সহজ হবে বলে মনে করেন তিনি।
আইআইডিএফসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম সারওয়ার ভূঁইয়া বলেন, বর্তমানে অর্থনীতির প্রধান সমস্যা তারল্য সংকট। এর ফলে দেশের ব্যাংক খাতের সুদের হারের পাশাপাশি পরিচালন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। যার দায়ভার পড়ছে সাধারণ ঋণগ্রহীতাদের ওপর। ব্যাংকনির্ভরতা কমাতে পুঁজিবাজারের দিকে নজর দেয়ার সময় এসেছে।