বৃহস্পতিবার, ২৫শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

হাজীগঞ্জে জৈব কৃষিতে সফল প্রবাস ফেরত যুবক সুমন

বিশেষ প্রতিবেদক 


প্রায় সাত লক্ষ টাকা খরচ করে অনেক স্বপ্ন নিয়ে ২০১১ সালে প্রবাসে পাড়ি জমান।প্রবাসে গিয়ে নয় বছরেও ভাগ্যের চাকা ঘুরেনি।হতাশ হয়ে ফিরে আসেন দেশে।আড্ডাবাজিতে না জড়িয়ে সারাদিন পড়ে থাকতেন মোবাইল নিয়ে।শাক সবজি চাষাবাদ সম্পর্কে ধারনা খুঁজতে থাকেন নেট দুনিয়ায়।সামান্যতম পড়াশোনা লব্ধ জ্ঞানের আলোকে ভিন্ন কিছু করতে চেয়েছেন।নিরাপদ খাদ্যের বিষয়টির ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন। রাসায়নিক চাষাবাদ আর ফরমালিন মিশ্রিত খাদ্যের বিষাক্ততার ছোবল থেকে গাঁয়ের মানুষকে সরিয়ে আনার ক্ষুদ্র প্রয়াস নেন তিনি।অবশেষে নিজের জমিতেই শুরু করেন জৈব পদ্ধতিতে শাক সবজি চাষাবাদ।শাক সবজির চাষ করে চমকে দেন কৃষি বিভাগের বড় বড় কর্মকর্তাদের।অঁজপাড়াগাঁ থেকে বিষমুক্ত শাক সবজির চাহিদা বাড়তে থাকে গাঁয়ের হাট বাজারে।গাঁয়ের মানুষের কাছে তিনি এখন জৈব পদ্ধতিতে চাষাবাসের পথ প্রদর্শক হিসেবেই পরিচিত।
এই তরুণ উদ্যোক্তার নাম সুমন দেবনাথ (৩৯)।চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ উপজেলার ১০নং গন্ধব্যপুর ইউনিয়নের কাশিমপুর গ্রামের চিত্তরঞ্জন দেবনাথের একমাত্র ছেলে সুমন। সুমন দেবনাথের আগ্রহ ছিলো গ্রামের মানুষের কল্যাণে কিছু করা। নিরাপদ খাদ্যের বিষয়টি বিশ্বব্যাপী আলোচনার এই সময়ে দেশের মানুষের জন্য তা উৎপাদনের চিন্তা আসে তার মাথায়। একদিকে চাষাবাদে বিষাক্ত কীটনাশক ও রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হচ্ছে, অন্যদিকে খাদ্যে দেয়া হচ্ছে ফরমালিন। জলবায়ু পরিবর্তন মানুষের স্বাস্থ্য ঝুঁকিও বাড়াচ্ছে। বাড়ছে রোগব্যাধি। সার্বিক এই অবস্থায় সুমন দেবনাথের এই জৈব কৃষি পদ্ধতি আশার আলো দেখাচ্ছে।গ্রামীণ কৃষিতে ‘অর্গানিক’ বা জৈব পদ্ধতির চাষাবাদ অনুসরণীয়। সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপায়ে এই কৃষি পদ্ধতি এখন হাজীগঞ্জের গ্রাম থেকে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ছে।জৈব পদ্ধতিতে  চাষাবাদে তরুণদের পাশাপাশি কৃষকরাও উৎসাহিত হচ্ছন।অনুসরণ করছেন সুমনকে।চাষাবাদের আদিম পদ্ধতি শিখে চেষ্টা করছেন নিজে স্বাবলম্বী হওয়ার। জৈব কৃষিতে সুমনের সাফল্যের পেছনে যার অবদান সবচেয়ে বেশি তিনি হলেন হাজীগঞ্জ উপজেলার সাবেক কৃষি কর্মকর্তা মাজেদুর রহমান।সুমন আনন্দচিত্তে বলেন,মাজেদুর রহমান স্যার আমাকে সব ধরনের সহযোগিতা করেছেন।যার কারণে আমি আজ জৈব কৃষিতে সফল মানুষ।
জৈব পদ্ধতির ব্যবহার করে  সুমন প্রায় সত্তর শতাংশ  জমিতে চাষ করছেন নবাব জাতের করলা,ময়না জাতের লাউ,বাহুবলি জাতের টমেটো, ঝিঙা, সাবিরা জাতের শসা,রকমেলন,চিচিঙ্গা,ক্যাপসিকাম।এসব বিষমুক্ত শাক সবজি চাষ করে আশানুরূপ ফসল পেয়েছেন তিনি।৩৫ শতাংশ জমিতে টমেটো চাষ করে প্রায় ৩০০মন টমেটো বিক্রি করেছেন।বাড়ির  উঠানে প্রায় ৩শতাংশ জমিতে মাত্র এক হাজার টাকা খরচে লাউ চাষ করে ৫০হাজার টাকার লাউ বিক্রি করেছেন।এখনও লাউ ঝুলছে সুমনের মাচায়।শসা ক্ষেতে ঝুলছে শসা।ফলন তোলার সাথে সাথেই মানুষ কিনে নিচ্ছেন সুমনের জৈব পদ্ধতিতে চাষের সবজি।এছাড়াও সুমন ভার্মি কম্পোস্ট সার নিজে তৈরি করে বিক্রি করছেন বিভিন্ন এলাকার কৃষকদের মাঝে।প্রায় ৩ একর এরিয়াতে আছে সুমনের মাছের প্রজেক্ট।মাত্র তিন বছরেই কঠোর পরিশ্রম করে সুমন বদলে নিয়েছেন নিজের জীবনের গতিপথ।সুমন এখন আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী।সুমনের জৈব কৃষিতে সফলতা দেখে অনেক বেকার যুবক বিভিন্ন গ্রামে শুরু করেছেন জৈব পদ্ধতিতে শাক সবজি চাষাবাদ।সুমন এখন বেকার যুবকদের জৈব কৃষির পথ পদর্শক।জৈব কৃষি নিয়ে সুমনের স্বপ্ন অনেক বড় কিছু করার।সরকারী সহযোগিতা পেলে সুমন তাঁর নিজের স্বপ্নের পথে এগিয়ে যাবেন।এলাকার বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানের স্থায়ী ব্যবস্থা করবেন এমনটাই জানিয়েছি তিনি।
উদ্যোক্তা সুমনের মতে, রাসায়নিক সার দিয়ে চাষাবাদ পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। খাদ্য উৎপাদন খরচও বেশি হয়। জৈব সার দিয়ে চাষাবাদ পরিবেশসম্মত ও উৎপাদন খরচ কম হয়। উৎপাদিত খাদ্য স্বাস্থ্যসম্মত। এ কারণে এদিকে ঝোঁক রয়েছে অনেকের। জৈব কৃষি প্রযুক্তির  কাজে  তার বাবা ও স্ত্রীকে  সম্পৃক্ত করেন। রাসায়নিক সার, রাসায়নিক কীটনাশক, গ্রোথ হরমোনসহ যে কোনো রাসায়নিক পদ্ধতি ছাড়া জৈব সার ও জৈব কীটনাশক দিয়ে পরিবেশবান্ধব উপায়ে ফসল উৎপাদন করাই হচ্ছে অর্গানিক ফার্মিং বা জৈব কৃষি।
অভিযোগ রয়েছে,হাজীগঞ্জ উপজেলার ১০ নং গন্ধব্যপুর দক্ষিণ ইউনিয়নের কাশিমপুর ব্লকের ব্লকের দায়িত্বে থাকা কৃষি উপসহকারী বছরে একবারও দেখা দেন না কোনো কৃষকের সাথে।এমনকি ফোন করেও পাওয়া যায়না তাঁকে।তিনি বিভিন্ন সার কীটনাশক ডিলারদের দোকানে ব্যস্ত থাকেন সব সময়।কৃষকের জন্য কৃষি ব্লকে বরাদ্দকৃত উপকরণ আত্মসাৎ করার অভিযোগও রয়েছে এই উপসহকারীর বিরুদ্ধে।
জৈব কৃষি সম্পর্কে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক অবসরপ্রাপ্ত কৃষি কর্মকর্তা বলেন,সরকার ২০১৬ সালে ‘জৈব কৃষিনীতি’ অনুমোদন করেছে। নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত ফসল উৎপাদনের কথা বিবেচনায় রেখে বর্তমান সরকার নিরাপদ খাদ্য আইন–২০১৩ প্রণয়ন করেছে, যার ৫৮ ধারায় বলা আছে যে ‘মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বা বিষক্রিয়া সৃষ্টিকারী রাসায়নিক দ্রব্য, কীটনাশক বা বালাইনাশকের অতিরিক্ত ব্যবহারের জন্য ৫ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং ১০ লাখ টাকা জরিমানা দিতে হবে।’বিষমুক্ত সবজি’ নিয়ে আমাদের নিত্যদিনের ভাবনাকে নির্বিষ করে দিতে পারে ‘জৈব কৃষি’। এতে কৃষক পণ্যের মূল্য বেশি পাবেন, পরিবেশ থাকবে দূষণমুক্ত আর আমাদের সোনা ফলানো মাটি হবে আরও উর্বর।

Comments are closed.

More News Of This Category