বৃহস্পতিবার, ২৫শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

অনিয়মে প্রকল্পের সুবিধা বঞ্চিত হচ্ছেন প্রান্তিক কৃষকগণ  

♦ নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষ্মীপুর,চট্টগ্রাম ও চাঁদপুর কৃষি উন্নয়ন প্রকল্প
 চাঁদপুর প্রতিনিধি 

চাঁদপুরে কতিপয় কৃষি উপসহকারী কর্মকর্তার অনিয়মের কারনে কৃষি উন্নয়ন প্রকল্পের সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন কৃষকগণ। কৃষি মন্ত্রনালয়ের আওতাভুক্ত কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর (ডিএই) কতৃক  বাস্তবায়নাধীন  নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষ্মীপুর,চট্টগ্রাম ও চাঁদপুর কৃষি উন্নয়ন প্রকল্প।২০১৮ -২০১৯ অর্থবছরের জুলাইতে এডিপিভুক্ত এ প্রকল্পটি চালু হয়।প্রকল্প চালু হওয়ার পর থেকেই চাঁদপুর জেলার বিভিন্ন উপজেলায় প্রান্তিক কৃষকদের প্রকল্পের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।
প্রকল্পের মাধ্যমে প্রান্তিক কৃষকদের মাঝে খামারের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান কতৃক প্রমাণিত প্রযুক্তির সম্প্রসারণ,পতিত জমি চাষের আওতায় আনা, একক ও বহুবিধ ফসলের আবাদ বৃদ্ধি, শস্যের নিবিড়তা বৃদ্ধিকরণের মাধ্যমে প্রকল্প এলাকায় কৃষি উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করা,মাঠ পর্যায়ের কার্যকরী সম্প্রসারণ সেবা প্রদানের জন্য কৃষি ও কৃষকের দক্ষতা বৃদ্ধি করা, কৃষি উৎপাদন কার্যক্রমে মহিলাদের সক্ষমতা বৃদ্ধির কথা থাকলেও বিভিন্ন জেলার উপজেলার কৃষি উপ-সহকারী কর্মকর্তাদের নানান অনিয়মের কারণে প্রকল্পের আশানুরূপ কোনো অগ্রগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে না।

জেলার হাজীগঞ্জ, শাহরাস্তি, কচুয়া, ফরিদগঞ্জ উপজেলার  কৃষি ব্লকের চাষিদের সাথে আলাপকালে জানা যায়,প্রয়োজনীয় কৃষি উপকরণ, প্রশিক্ষণ ভাতা,যাতায়াত খরচ, সার,বীজ,বালাইনাশক সহ ফসলের আন্তঃপরিচর্যার বরাদ্দকৃত  টাকা প্রদানেও কৃষি উপ-সহকারীগণ নয়ছয় করেছেন।এছাড়াও বিভিন্ন কৃষি ব্লকে প্রকৃত কৃষকদের নাম তালিকাভুক্ত না করে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, ইউপি মেম্বারের ছেলে, স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিগণ কৃষি উপ-সহকারীদের সহায়তায় কৃষক সেজে প্রশিক্ষণে অংশ নিয়ে ফসলভেদে প্রকল্পের বরাদ্দকৃত কৃষি উপকরণ আত্মসাৎ করা সহ প্রশিক্ষণ ভাতা ও যাতায়তের নগদ অর্থ আত্মসাত করার অভিযোগ রয়েছে।
 জানা যায়, হাজীগঞ্জ উপজেলায় ২০২০-২০২১ অর্থবছরে এ প্রকল্পের আওতায় ৩৭ টি কৃষি ব্লকে ১২ জন চাষি পেঁয়াজ চাষ করেন। পেঁয়াজ প্রদর্শনীর উপকরণ বিতরণে হাজীগঞ্জ উপজেলা কৃষি  উপসহকারী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ করেন বিভিন্ন ব্লকের ভুক্তভোগী কৃষকগণ।অভিযোগের সূত্র ধরে অনুসন্ধান করা হয় অনুসন্ধানে  প্রকল্পের অর্থ লোপাটের আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া যায়।উপজেলার ১২ নং দ্বাদশগ্রাম ইউনিয়নের কাপাইকাপ ব্লকের পেঁয়াজ চাষি কাউছার হোসেন পেঁয়াজ চাষের আন্তঃপরিচর্যার এক হাজার সাত শত টাকা পাওয়ার কথা থাকলেও তিনি এক টাকাও পাননি।৪নং কাঁলোচো ইউনিয়নের কাঁলোচো ব্লকের পেঁয়াজ চাষি হেদায়েত উল্লাহ পাননি বরাদ্দকৃত বালাইনাশক ।তিনি আন্তঃপরিচর্যার এক হাজার  সাত শত টাকা পাওয়ার কথা থাকলেও পেয়েছেন এক হাজার পাঁচ শত টাকা। ৩নং কাঁলোচো ইউনিয়নের মাড়কি ব্লকের মোঃ নূরুল আমিন আন্তঃপরিচর্যার এক  হাজার সাত শত টাকা পাওয়ার কথা থাকলেও পেয়েছেন এক হাজার টাকা মাত্র।এছাড়াও ১২ জন পেঁয়াজ চাষির মধ্যে অনেকেই পাননি বালাইনাশক।কোনো কোনো কৃষক প্রয়োজনের তুলনায় পেঁয়াজ বীজ পেয়েছেন অনেক কম।কেউ কেউ পেয়েছেন আধা কেজি পরিমাণ বীজ।
এছাড়াও পেঁয়াজ চাষি তালিকায় ভুয়া নাম অর্ন্তভুক্ত করে অর্থ লোপাটের ঘটনাও ঘটেছে।উপজেলার ২নং বাকিলা ইউনিয়নের শ্রীপুর ব্লকের রাধাসার গ্রামের পেঁয়াজ চাষি মোঃ সোহাগ তফাদার পিতা আঃ রব তফাদার কাগজে কলমে উল্লেখ থাকলেও কৃষকের মোবাইল নম্বরের(০১৮৭০৯৪৮৪০*)সূত্র ধরে অনুসন্ধান করলে জানা যায়,এই মোবাইল নম্বরটি ব্যবহার করছেন উপজেলার ৫নং সদর ইউনিয়নের অলিপুর সর্দার বাড়ির মৃত আবদুল মতিনের ছেলে জাহাঙ্গীর নামে জনৈক এক ব্যক্তি এবং ঐ মোবাইল নম্বরটি রেজিষ্টেশন করা আছে নাসিমা নামে কোন এক অপরিচিত নারীর নামে।



মে মাসে হাজীগঞ্জে তিন দিনব্যাপী কৃষক-কৃষাণীদের প্রশিক্ষণ সম্পন্ন হয়েছে।নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষ্মীপুর,চট্টগ্রাম ও চাঁদপুর কৃষি উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় এই প্রশিক্ষণ সম্পন্ন হয়। হাজীগঞ্জে  কৃষক- কৃষাণীদের মধ্যে যারা প্রশিক্ষণ নিয়েছেন তাদের অনেকেই কৃষক নয়।কৃষি জমিও নেই। কৃষি কাজও করেন না।কেউ রাজনৈতিক নেতা, কেউ মেম্বারপূত্র, কেউ স্থানীয় প্রভাবশালী, কেউ ইউনিয়নের নেতা অনুসন্ধানকালে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া যায়।জানা  যায়, উপজেলার ৮নং পূর্ব হাটিলা ইউনিয়নের বেলঘর গ্রামের আঃ গনি মেম্বারের পূত্র নাজমুল হোসেন হাজীগঞ্জ ডিগ্রী কলেজে অধ্যয়নরত। পেশায় কৃষক না হলেও নিয়েছেন কৃষি প্রশিক্ষণ ও ভাতা। একই গ্রামের দেলোয়ার হোসেন পাটোয়ারীর ছেলে হাসান পাটওয়ারী পেশায় কৃষক নয়।কোনোদিন কৃষি কাজও করেনি।হাসান পাটওয়ারী ও নিয়েছেন প্রশিক্ষণ ভাতা। এছাড়া একই ইউনিয়নের পূর্ব হাটিলা গ্রামের মৃত দাউদ ইসলামের ছেলে আলমগীর হোসেন কৃষি কাজের সাথে সম্পৃক্ত না থাকলেও নিয়েছেন কৃষি প্রশিক্ষণ ও ভাতা। ‘কৃষিই সমৃদ্ধি’ শ্লোগানের এই হলো সমৃদ্ধির নমুনা।

এ ব্যাপারে হাজীগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোঃ মাজেদুর রহমান বলেন, বিভিন্ন কৃষি ব্লকে কৃষি উপ সহকারীগণ অনিয়ম করে থাকলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
উপজেলায় কর্মরত কৃষি উপসহকারীদের অনেকেই জানান,কৃষি অফিসার আন্তঃপরিচর্যার টাকা দিয়েছেন নিজেই।এ ব্যাপারে আমরা কিছুই জানিনা। 
 
অনুসন্ধানকালে আরও জানা যায়,শাহরাস্তি উপজেলার ৩১ টি কৃষি ব্লকে পেঁয়াজ চাষ করেছেন ১৫ জন কৃষক।কৃষকদের মধ্যে সূচীপাড়া উত্তর ইউনিয়নের ধামরা ব্লকের হাড়াইরপাড় গ্রামের মৃত আবদুল হামিদ পাটোয়ারির ছেলে মিজানুর রহমান ৩৩ শতাংশ জমিতে পেঁয়াজ চাষ করেছেন তিনি ফসলের আন্তঃপরিচর্যার কোন টাকা পাননি বলে জানান।একই উপজেলার সূচীপাড়া দক্ষিণ ইউনিয়নের নরিংপুর গ্রামের নরিংপুর ব্লকের মৃত মমতাজুর রহমানের পূত্র মোঃ ফরিদ শেখ পেঁয়াজ চাষ করেছেন ঠিকই কিন্তু তিনি বালাইনাশক ও আন্তঃপরিচর্যার এক হাজার সাত শত টাকা পাননি।উপজেলার সূচীপাড়া দক্ষিণ ইউনিয়নের রাগৈ গ্রামের রাগৈ ব্লকের প্রয়াত সুরেন্দ্রকুমার দেবনাথের ছেলে অমৃতলাল দেবনাথ  পেঁয়াজ চাষ করেছেন।পুরো জমিতে দুই কেজি ফসল ও পাননি তিনি। ফসলের আন্তঃপরিচর্যার কোনো টাকা তাঁর ভাগ্যে জুটেনি।কৃষক তালিকায় অমৃতলালের নাম থাকলেও কৃষি  প্রশিক্ষণ নিয়েছেন তাঁর সহধর্মিণী শিখা রাণী। প্রশিক্ষণের সময় শিখা রাণী আট শত টাকা ও একটি খাতা আর কলম পেয়েছেন।ফসলের আন্তঃপরিচর্যার টাকা তিনি পাননি।পেঁয়াজের বীজ পেয়েছেন আধা কেজি।
কচুয়া উপজেলার ৩৭ টি কৃষি ব্লকের অধিকাংশ পেঁয়াজ চাষি ফসলের আন্তঃপরিচর্যার টাকা পাননি। অনুসন্ধানকালে অনিয়ম ধরা পড়ার ভয়ে পেঁয়াজ তোলার এক মাস পর চাষিদের ডেকে এনে আন্তঃপরিচর্যার টাকা পরিশোধ করেন একজন কৃষি উপসহকারী।উপজেলার ৭নং কচুয়া দক্ষিণ ইউনিয়নের তুলপাই ব্লকের কৃষক ইসমাইল হোসেন ১২ শতাংশ জমিতে পেঁয়াজ চাষ করেন। পেঁয়াজ তোলার এক মাস পর তিনি আন্তঃপরিচর্যার টাকা পান।একই ইউনিয়নের আকানিয়া ব্লকের আরেক কৃষক ইসমাইল ও পেঁয়াজ তোলার প্রায় এক মাস পর আন্তঃপরিচর্যার টাকা পেয়েছেন।পেঁয়াজ বীজ সার,বালাইনাশক পাওয়ার কথা থাকলেও কেউ কেউ পেঁয়াজের চারা পেয়েছেন।সার পেয়েছেন পরিমানের চেয়ে অনেক কম।কচুয়ায় কোথাও পেঁয়াজের আশানুরূপ ফলন হয়নি বলে জানান পেঁয়াজ চাষিগণ।
ফরিদগঞ্জ উপজেলার ৪৮ টি কৃষি ব্লকে পেঁয়াজ চাষ করেছেন ১৫ জন কৃষক।উপজেলার ১নং বালিথুবা পশ্চিম ইউনিয়নের সেকদি কৃষি ব্লকের পালতালুক গ্রামের মৃত আবদুর রহিম মিয়াজীর পুত্র নূরুল ইসলাম বেপারী পেঁয়াজ চাষ করার সময় মাত্র দুইশত টাকা পেয়েছেন বলে জানান।নুরুল ইসলাম বেপারীর পেঁয়াজের ফলন খুব ভালো হয়েছে।উপজেলার ৮নং পাইকপাড়া দক্ষিণ ইউনিয়নের গাজীপুর কৃষি ব্লকের গাজীপুর গ্রামের মৃত আবদুছ সোবাহানের পূত্র মোঃ আবু তাহের তফাদার পেঁয়াজের আন্তঃপরিচর্যার এক টাকাও পাননি বলে অভিযোগ করেন।ফরিদগঞ্জে পেঁয়াজের বাম্পার ফলন হয়েছে বলে জানান কয়েকজন পেঁয়াজ চাষি।
কাগজে কলমে ফসলের প্রদর্শনী প্লটভিত্তিক ভৌত অগ্রগতি  শতভাগ দেখানো হলেও জেলার কচুয়া, হাজীগঞ্জ, শাহরাস্তি উপজেলার পেঁয়াজ চাষিরা পেঁয়াজের আবাদ করে আশানুরূপ ফলন পায়নি। প্রায় প্রতিটি কৃষি ব্লকের উপ-সহকারীগণ চাষিদের জন্য বরাদ্দকৃত পেঁয়াজ ফসলের আন্তঃপরিচর্যার টাকা হরিলুট করেছেন।অনেক দেরিতে বীজ পেয়েছেন বলেও অভিযোগ করেন অধিকাংশ
কৃষকগণ।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে হাজীগঞ্জ, শাহরাস্তি, কচুয়া,ফরিদগঞ্জ উপজেলার কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তাগণ কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তবে কৃষি কর্মকর্তাগণ অনিয়মের বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন বলে জানান। হাজীগঞ্জ, শাহরাস্তি, কচুয়া,ফরিদগঞ্জ উপজেলার কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তাগণ প্রকল্পের অগ্রগতি,চলমান কার্যক্রম সম্পর্কে তথ্য দিতে গড়িমসি করেন।
 প্রকল্পের বিভিন্ন অসংগতি অনিয়ম সম্পর্কে জানতে চাইলে নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষ্মীপুর,চট্টগ্রাম ও চাঁদপুর কৃষি উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক মোঃ লুৎফর রহমান জানান, এসব অনিয়মের বিষয়ে আমি অবগত নই।এসব বিষয়গুলো প্রকল্পের আওতাভুক্ত প্রতিটি উপজেলার কৃষি কর্মকর্তাগণ দেখেন।কেউ অনিয়ম করে থাকলে তাঁদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে। প্রকল্পের আওতাভুক্ত কৃষকদের স্বার্থ সংশিষ্ট সকল বিষয়ে আমি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কৃষি প্রশিক্ষণ চলাকালে কৃষকদের সচেতন থাকার পরামর্শ দেই।

Comments are closed.

More News Of This Category