শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

অনুসন্ধান : অগ্নিঝুঁকি নিরুপনই করেনি ফায়ার সার্ভিস!

বিশেষ প্রতিবেদক ,ক্রাইম রিপোর্ট []গুলশানের ডিএনসিসি মার্কেটে আগুন লাগার পর ২০১৭ সালে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে ঢাকাকে চারটি অঞ্চলে বিভক্ত করে সব ধরনের স্থাপনার অগ্নিঝুঁকি পরিদর্শনের উদ্যোগ নেয়া হয়। সেখানে অগ্নিঝুঁকিতে থাকা হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিপণি বিতান ও বিভিন্ন বহুতল বাণিজ্যিক ভবনের তথ্য উঠে আসে।

ফায়ার সার্ভিসের ওই তালিকায় ঠাঁই পায়নি বনানীর বহুতল বাণিজ্যিক ভবন এফ আর টাওয়ারের নাম। ২৫ তলা ওই বাণিজ্যিক ভবনের অগ্নিঝুঁকি নিরূপণে কোনো পরিদর্শনই চালানো হয়নি!

ফায়ার সার্ভিসের পলিথিন দিয়ে জোড়া দেয়া পাইপে বসে পাইপের ছিদ্র বন্ধ করতে ছোট্ট বালকের চেষ্টা

জানা গেছে, ফায়ার সার্ভিসের বনানী এলাকার বাণিজ্যিক ভবনগুলোর অগ্নিঝুঁকি নিরূপণে পরিদর্শন কার্যক্রম চালানোর দায়িত্বপ্রাপ্ত ইউনিট ছিল বারিধারা ফায়ার স্টেশন। এ স্টেশনের পক্ষ থেকে গুলশান, বনানী, বারিধারা ও ভাটারা এলাকার বিভিন্ন বাণিজ্যিক ভবনে পরিদর্শন কার্যক্রম চালানো হয়। পরিদর্শন দলগুলোর ১ নম্বর টিমের পক্ষ থেকে পরিদর্শন করা বাণিজ্যিক ভবনগুলোর মধ্যে ঝুঁকির তালিকায় শীর্ষে রয়েছে ৪৬ কামাল আতাতুর্ক এভিনিউয়ের আলহাজ গোলাম কিবরিয়া ম্যানশনটি। ওই ভবনের মাত্র আধা কিলোমিটারের মধ্যেই এফ আর টাওয়ারের অবস্থান। ২৫ তলাবিশিষ্ট এ বাণিজ্যিক ভবনের অগ্নিঝুঁকি নিরূপণে কোনো পরিদর্শনই চালানো হয়নি।

এ স্টেশনের কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ ক্রাইম রিপোর্টকে বলেন, বেশ কয়েকটি টিম গঠন করে পুরো বনানী এলাকার বাণিজ্যিক ভবনগুলোর অগ্নি ও ভূমিকম্প ঝুঁকি নিরূপণের জন্য বলা হয়েছিল। পরিদর্শন টিমের সদস্যরা যখন এসেছিলেন, তখন হয়তো এফ আর টাওয়ার বন্ধ ছিল। তা না হলে বনানী এলাকার এমন বহুতল বাণিজ্যিক ভবন কোনোভাবেই অগ্নি ও ভূমিকম্প ঝুঁকি পরিদর্শন থেকে বাদ পড়ার কথা নয়।

 

অগ্নিঝুঁকি নিরূপণ না হওয়া এফ আর টাওয়ারের আগুন নিয়ন্ত্রণে দমকল কর্মীদের সময় লেগেছে ৭ ঘণ্টার বেশি। ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকারী দলের সদস্য আল আমিন জানান, এফ আর টাওয়ারের নিচতলায় কিছু বিপণি বিতান ছিল। সপ্তম তলায় ছিল একটি রেস্টুরেন্ট। এছাড়া অন্যান্য ফ্লোরে বিভিন্ন কোম্পানির করপোরেট অফিস ছিল। এখানে প্রতিদিন এক থেকে দেড় হাজার মানুষ অবস্থান করতেন।

অথচ ভবনটিতে জরুরি নির্গমনের জন্য কোনো সিঁড়ি ছিল না।

তাছাড়া ভবনটিতে প্রয়োজনীয়সংখ্যক স্মোক ডিটেক্টর ও বহনযোগ্য অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রও ছিল না। এজন্যই আগুন লাগার বেশ কিছুক্ষণ পর ভবনের লোকজন বিষয়টি বুঝতে পারেন। এ ভবনটিতে যদি প্রয়োজনীয়সংখ্যক স্মোক ডিটেক্টর থাকত, সে ক্ষেত্রে আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গেই ফ্লোরগুলো থেকে অনেকেই বেরিয়ে আসতে পারতেন বলেও জানান ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকারী দলের এ সদস্য।

এফ আর টাওয়ারের পাশেই সুফিয়া টাওয়ার। ১৪ তলা এ বাণিজ্যিক ভবনটিতে রয়েছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের করপোরেট অফিস। গুরুত্বপূর্ণ এ ভবনটিতেও অগ্নিঝুঁকি নিরূপণে পরিদর্শন চালায়নি ফায়ার সার্ভিস।

জানা গেছে, সংস্থাটির পক্ষ থেকে রাজধানীর ১ হাজার ২২৫টি বাণিজ্যিক ভবন এবং ব্যাংকের শাখা রয়েছে এমন ৬৯২টি ভবন পরিদর্শন করা হয়। অগ্নি দুর্ঘটনা রোধে সক্ষমতা যাচাইয়ের এ প্রক্রিয়ায় ভবনগুলোর মাটির নিচের জলাধারের ধারণক্ষমতা, অবস্থানকারীর সংখ্যা, প্রবেশদ্বারের প্রশস্ততা, ধোঁয়া ও তাপ শনাক্তকরণ যন্ত্রের উপস্থিতি, ভবনের মেঝের আয়তন, জরুরি বহির্গমন সিঁড়ি ও প্রয়োজনীয় লিফট আছে কিনা ইত্যাদি বিবেচনায় নেয়া হয়। এর ভিত্তিতে ভবনগুলোকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ ও ‘অতি ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। পাশাপাশি অগ্নিঝুঁকি মোকাবেলার পর্যাপ্ত প্রস্তুতি থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোকে চিহ্নিত করা হয় ‘সন্তোষজনক’ বলে।

ফায়ার সার্ভিসের পরিদর্শন প্রতিবেদনে ঢাকার ১ হাজার ২৭৫টি বাণিজ্যিক ভবনের মধ্যে ৫৪১টি অতি ঝুঁকিপূর্ণ, ৬৮৭টি ঝুঁকিপূর্ণ ও মাত্র ৪৭টি সন্তোষজনক হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকের শাখা রয়েছে এমন ৬৯২টি ভবনের মধ্যে অগ্নিঝুঁকি মোকাবেলার পর্যাপ্ত সক্ষমতা রয়েছে মাত্র ৪৩টির। বাকি ৬৪৯টির মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণের তালিকায় রয়েছে ৪৭৬টি ও খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে ১৭৩টি ভবন।

ভবনের সঙ্গে রাজউক অনুমোদিত নকশার মিল নেই: রাজধানীর বনানীর কামাল আতাতুর্ক এভিনিউর এফ আর টাওয়ার ভবনটি নির্মাণে রাজউকের অনুমোদন ছিল ১৮ তলার। যদিও ভবন নির্মাণ করা হয়েছে ২৩ তলা। এছাড়াও রাজউক অনুমোদিত নকশা থেকে নির্মিত ভবনের নকশায় বেশকিছু বিচ্যুতিও পাওয়া গেছে। এফ আর টাওয়ারে আগুন লাগার পর ভবনের কাগজপত্র যাচাই করে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) এ তথ্য জানিয়েছে।

যোগাযোগ করা হলে রাজউক চেয়ারম্যান আবদুর রহমান বলেন, অগ্নিকাণ্ডের পর ভবনটি সম্পর্কে এ তথ্য পাওয়া গেছে। ভবনটির ফাইলে দেখা গেছে, ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর এফ আর টাওয়ারের নকশায় অনুমোদন দেয়া হয়। অনুমোদিত নকশায় ভবনের উচ্চতা ১৮ তলা। যদিও নির্মাণ করা হয়েছে ২৩ তলা। এছাড়াও রাজউকের অনুমোদিত নকশা থেকে নির্মিত ভবনের আরো অনেক বিচ্যুতি রয়েছে।

রাজউক চেয়ারম্যান জানান, ২০০৫ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি এফ আর টাওয়ারের মালিকপক্ষ রাজউকের কাছে আরেকটি নকশা জমা দেয়। সেটির সঙ্গে রাজউকে সংরক্ষিত নকশার কোনো মিল নেই। অর্থাৎ ২০০৫ সালে তারা যে নকশা জমা দিয়েছিল, তা বৈধ ছিল না। ১৯৯৬ সালে মূল যে নকশায় রাজউক অনুমোদন দিয়েছিল, তার সঙ্গেও নির্মিত ভবনটির অনেক বিচ্যুতি রয়েছে। এ বিষয়ে ২০০৭ সালে রাজউক একটি প্রতিবেদনও তৈরি করে। ভবনটির নির্মাণকাজে যারা জড়িত, তাদের সবারই শাস্তি নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category