শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১৩ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

এই ধর্ষকামী রাষ্ট্রে ধর্ষণ এক মহামারির নাম

 

লাবণী মন্ডল 


ধর্ষণ। একটি শব্দ। যে শব্দটি শুনলেই চেতনার সেলগুলো নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। স্তব্ধ হয়ে যায় ভাবনার জগত। পৃথিবীর কোনো সৌন্দর্যই চোখের সামনে ধরা পরে না। পৃথিবীর কারো প্রতি আস্থা রাখার মানসিকতা হারিয়ে ফেলা যায়। তেমন একটা শব্দ, যে শব্দের ব্যবহার মহামারী আকার ধারণ করেছে।
এই রাষ্ট্র ধর্ষণের শিকার হওয়াকে জীবনের বড় অভিজ্ঞতা মনে করছে। ধর্ষণের শিকার হয়ে নারীকে তার জীবনের অভিজ্ঞতার ঝুড়ি ভারি করতে হচ্ছে!
জানুয়ারি ২০২০, ১৩ তারিখ পর্যন্ত ধর্ষণের শিকার হয়ে ১৩ জন ঢাকা মেডিকেলের ওসিসিতে ভর্তি। এটা একটা তথ্য। বুর্জেোয়া মিডিয়ার তথ্য। এর বাইরের যে খবরগুলো ঘটেছে, ২০২০ সালের ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত তার সব খবর আমরা জানি না, জানা সম্ভবও না।
পত্রিকার দশটি খবরের মধ্যে পাঁচটিই ধর্ষণের খবর। নিজেকে বেশ অসহায় লাগে। অসুস্থ লাগে। হতাশায় ভুগি। আতঙ্কবোধ করি। এই বুঝি কেউ ধরবে, নিয়ে যাবে ঝোপের আড়ালে। ধর্ষণ করে ছেড়ে দিবে কিংবা পৈশাচিকভাবে হত্যা করবে। সারাক্ষণ এরকম চিন্তা মাথায় নিয়ে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে এই যখন পরিস্থিতি তখনই মনে হচ্ছে, না বেঁচে থাকাটা জরুরি।
যাইহোক, নিউজগুলো বলছি- ‘মৌলভীবাজারে কলেজ থেকে বাড়ি ফেরার পথে গণধর্ষণের শিকার দুই বান্ধবী’, ‘ওষুধ কিনতে গিয়ে ধর্ষণের শিকার তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী’, ‘চরফ্যাশনে স্বামীকে খুঁজতে এসে ‘ধর্ষণের শিকার’ গৃহবধূ’, ‘সৌদিতে ধর্ষণের শিকার বাংলাদেশি কিশোরী’, ‘বাসাভাড়া দিতে না পারায় স্বামীকে আটকে নারীকে গণধর্ষণের অভিযোগ’, ‘ধার শোধ করতে না পেরে মেয়েকে মহাজনের হাতে তুলে দেয় বাবা’, ‘পিঠা কিনে বাড়ি ফেরার পথে ধর্ষণের শিকার স্কুলছাত্রী’… এগুলো বুর্জেোয়া মিডিয়ার খবর। আরো বহু খবর রয়েছে যা আমার চোখে পড়েনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ধর্ষণের শিকার হওয়ার খবর নিশ্চয়ই সবাই জানেন। কী ভয়ংকর! কী দুবির্ষহ চিত্র! যে চিত্র প্রতিদিন অবলোকন করে করে আমাদেরকে এগিয়ে যেতে হচ্ছে। আসলে, কোনোকিছুই তো থেমে নেই। এই রাষ্ট্র ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন দমানোর জন্য ‘ধর্ষক’কে গ্রেপ্তার করার নামে নাটক সাজায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীর ধর্ষণের ঘটনায় যে ‘ধর্ষক’কে গ্রেপ্তা করা হলো তা নিয়েও অনেকের প্রশ্ন রয়েছে। তবে রাষ্ট্র যে এ ধরনের নাটক সাজায় তা তো সবাই জানে। আর এটার বেলায় তা নাটক কিনা সত্য সেটাও খতিয়ে দেখার বিষয়।
এই রাষ্ট্রের বড় ভয়! জনগণের আন্দোলনকে বড় ভয় পায়।
২০১৯ সালে এক হাজার ৪১৩ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। যা কিনা ২০১৮ সালে ছিল ৭৩২ জন, ২০১৭ সালে ছিল ৮১৮ জন। ২০১৯ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৯০২ শিশু, ২০১৮ সালে যে সংখ্যা ছিল ৩৫৬। গত বছরে ধর্ষিত ৯০২ শিশুর মধ্যে সাত থেকে ১২ বছরের শিশু ছিল ৩৯ শতাংশ আর ১৩ থেকে ১৮ বছর বয়সী ছিল ৪৮ শতাংশ।
এই পরিসংখ্যানও বুর্জোয়া মিডিয়ার। সেটা ধরলেও রাষ্ট্রব্যবস্থার অবস্থা বোঝা যায়। এই রাষ্ট্র ধর্ষকামী চিন্তা পোষণ করে। ধর্ষকদের লালন-পালন করে। আমরা জানি ধর্ষণের সেঞ্চুরি উৎসবের কথা। আমরা জানি পহেলা বৈশাখের নারী নিপীড়নের কথা। আমরা জানি বদরুলের কথা। আমরা জানি তনুর কথা, আফসানার কথা। নুসরাতকে পুড়িয়ে মেরে ফেলার কথাও আমরা ভুলিনি। একটা ঘটনা দিয়ে আরেকটা ঘটনাকে ধামাচাপা দেওয়ার যে অপচেষ্টা তাও আমরা ভুলতে পারি না।
২০১৯ সালেই ১৪১৩ জনে দাঁড়িয়েছে এবং ২০১৮ সালে ধর্ষণের শিকার হয় ৭৩২ জন। অর্থাৎ এক বছরেই ধর্ষনের ঘটনা দ্বিগুণ হয়েছে এবং ভয়াবহ মাত্রাই রূপ নিয়েছে। এমনকি নতুন বছরের শুরুও হয়েছে ধষর্ণের মাধ্যমে। এই ধর্ষণসহ খুন, রাহজানি, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা সবকিছুকে মদদ দিচ্ছে এই রাষ্ট্র, ফ্যাসিবাদী সরকার।
ছোট ছোট ছেলে শিশুদেরকে ধর্ষণের খবরও আমরা প্রতিনিয়ত পেয়ে থাকি। তাদেরকে মেরে ফেলার খবরও জানি। সবই রাষ্ট্রের চিত্র।
আমরা ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বরে ধর্ষণের খবর ভুলিনি। ধানের শীষে ভোট দেওয়ার অপরাধে চার সন্তানের মাকে ধর্ষণ করেছিল আওয়ামী লীগের পাণ্ডারা। এ বছর শুরু হয়েছিল ঢাবির ছাত্রী ধর্ষণের সংবাদ দিয়ে।
এই রাষ্ট্র পুরুষতন্ত্রকে ধারণ করে। সরকারপ্রধান পুরুষতন্ত্রকে লালন-পালন করে। ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবকলীগ, আওয়ামী লীগ ধর্ষণ করবে, আর মুক্তি পেয়ে যাবে, বিচার হবে না (যদিও এ রাষ্ট্রের বিচারে কোনো আস্থা নেই) এটাও আমরা জানি।
আবার আমরা এও জানি এর মধ্যদিয়েই আমাদেরকে লড়াটাই জারি রাখতে হবে।
ফ্যাসিবাদী সরকারের সুনামধন্য ছেলেরা একের পর এক ঘটনা ঘটিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে। আমরা জানি, আবরার ফাহাদকে কি নির্মমভাবে হত্যা করেছিল সন্ত্রাসী সংগঠন ছাত্রলীগের নেতারা। জনগণের টুঁটি চেপে ধরে ফ্যাসিবাদকে পাকাপোক্ত করতে চাচ্ছে এই সরকার। একইসাথে ধর্ষণের মহোৎসব চলছে। আর এই ধর্ষকদের পাহারা দিচ্ছে, এই রাষ্ট্র। এই রাষ্ট্র ধর্ষক তৈরির কারাখানা।
আর আমাদের নজরটা সেদিকেই দিতে হবে। দু’একজনের বিচার করে, দু’একজনকে গ্রেপ্তার করে যে এর সমাধান হবে না- এই বোধটা জরুরি।
এই রাষ্ট্রযন্ত্র কতটা ফ্যাসিস্ট তা আরো পরিষ্কার হয়, যখন ধর্ষকের সবোর্চ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করার বিল পাশ করে। এর মধ্যদিয়ে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যাকাণ্ডকে জায়েজ করে নেয়। আমাদেরকে এ বিষয়টিকে গভীরভাবে ভাবতে হবে। যেখানে আমরা কোনো শাস্তির জন্য “ফাঁসি’ হতে পারে না বলি, যে সময় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জেলখানা পর্যন্ত রাখা হচ্ছে না তখন এ দেশে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যাকাণ্ডকে ইনিয়ে-বিনিয়ে, আইনী ব্যবস্থার মধ্যদিয়ে বৈধতা নিচ্ছে। আমাদের সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। একজনকে ব্যক্তিকে ফাঁসি দিয়ে ‘ধর্ষণ’ বন্ধ করা যাবে না। প্রয়োজন পুরো ঘুণেধরা ব্যবস্থাকে পরিবর্তন করা, আমূল পরিবর্তন করা।
আমরা জানি, পুঁজিবাদী, ভোগবাদী, সাম্রাজ্যবাদী, সম্প্রসারণবাদী, সামন্তবাদী, পুরুষতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা যতদিন টিকে থাকবে ততদিন এ ধরনের ঘটনা ঘটতেই থাকবে। এই মৌলিক শত্রুগুলোকে চিহ্নিত করতে না পারলে কোনো সমাধান হবে না। এই মৌলিক শত্রুগুলোকে টিকিয়ে রেখে নারীমুক্তিও সম্ভব নয়।
একমাত্র এই ব্যবস্থাকে উচ্ছেদ করার মধ্যদিয়ে সমাজতান্ত্রিক, সাম্যবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার মধ্যদিয়েই ব্যাপক নিপীড়িত জনগণের মুক্তি মিলবে।

 

Comments are closed.

More News Of This Category