বৃহস্পতিবার, ২৫শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সারাবিশ্বে খেলাপী ঋণের হার কমছে বাড়ছে বাংলাদেশে!

নিউজ ডেস্ক


কোনো কোনো দেশ ঋণখেলাপির কাছ থেকে অর্থ উদ্ধারে কঠোর আইন করেছে। ঋণখেলাপি বিদেশে পালিয়ে গেলেও তার সম্পদ জব্দ করে অর্থ উদ্ধার করছে। কোনো দেশ আবার ঋণখেলাপির পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট কালো তালিকাভুক্ত করছে। সীমিত করে আনছে অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাও। এসবের ফলও মিলছে।

সারা বিশ্বেই খেলাপি ঋণের হার কমে আসছে। নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বাংলাদেশেও। তার পরও দেশে খেলাপি ঋণের হার না কমে উল্টো বাড়ছে। চলতি বছরের মার্চ শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের হার প্রায় ১২ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।

বিশ্বব্যাংক, বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকের তথ্য-উপাত্ত সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ‘সিইআইসিডাটা’র ওয়েবসাইটের তথ্য বিশ্লেষণ করে এমন চিত্রই পাওয়া গেছে। বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি বিশ্বব্যাংকের উপাত্ত বলছে, ২০১০ সালে সারা বিশ্বের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের গড় হার ছিল ৪ শতাংশের বেশি। ২০১৭ সালে এ হার ৩ দশমিক ৪৪ শতাংশে নেমে এসেছে। ২০১৮ সালেও এ হার নিম্নমুখী ছিল।

যদিও এর বিপরীত চিত্র বাংলাদেশে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০১০ সালে দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের হার ছিল ৭ দশমিক ২৭ শতাংশ। কিন্তু চলতি বছরের মার্চ শেষে এ হার ১১ দশমিক ৮৭ শতাংশে ঠেকেছে।

এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে খেলাপি ঋণের উচ্চহার ছিল পাকিস্তানে। ২০১৬ সালেও দেশটির ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ ছিল বিতরণকৃত ঋণের ১১ শতাংশের বেশি। চলতি বছরের মার্চ শেষে তা ৮ দশমিক ২ শতাংশে নেমে এসেছে।

তথ্য-উপাত্ত বলছে, এশিয়ার বড় অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে খেলাপি ঋণের হার বাড়ছিল ভারতে। ২০১৮ সালে দেশটির ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণ ১১ শতাংশ ছাড়িয়ে গিয়েছিল। কিন্তু নানা উদ্যোগে তা কমে এসেছে। ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ শেষে দেশটির ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের হার কমে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৩ শতাংশে। শুধু এশিয়া নয়, আমেরিকা, ইউরোপ ও আফ্রিকার সিংহভাগ দেশের খেলাপি ঋণ নিম্নমুখী। অধিকাংশ দেশের ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণই ৫ শতাংশের নিচে। কেবল জাতিগত সহিংসতা, যুদ্ধবিধ্বস্ত, সাম্রাজ্যবাদী বৃহৎ শক্তিগুলোর অর্থনৈতিক অবরোধ ও আধিপত্যবাদের শিকার হওয়া কিছু দেশ এবং ক্ষুদ্র অর্থনীতির কয়েকটি দেশের খেলাপি ঋণ দুই অংকের ঘরে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে দেশের ব্যাংকগুলো থেকে বিতরণকৃত ঋণ খেলাপি হয়ে যাচ্ছে। এতে অপ্রতিরোধ্য গতিতে বাড়ছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ও হার। খেলাপি ঋণকে দুর্যোগ হিসেবে চিহ্নিত করতে পারলে তবেই ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফিরবে।

খেলাপি ঋণের কারণে দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো বিজেএমসির মতো ভর্তুকিনির্ভর হয়ে চলছে বলে মনে করেন বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ কার্যালয়ের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, খেলাপি ঋণ দেশের অর্থনীতির জন্য যতটা হুমকি তৈরি করেছে, ততটা উদ্বেগ আমাদের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে দেখি না। ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে হলে খেলাপি ঋণকে সংকট (ক্রাইসিস) হিসেবে প্রথমে স্বীকৃতি দিতে হবে। জনগণের করের অর্থ থেকে মূলধন জোগান না দিলে অনেক আগেই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো ভেঙে পড়ত।

তিনি বলেন, দেশের ব্যাংকিং খাতে যে সংকট তৈরি হয়েছে, এটি প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক। যখন পুরো ব্যাংকিং সিস্টেমের ওপর অনাস্থা তৈরি হবে কিংবা সিস্টেম ব্যর্থ হবে, তখন পুরো অর্থনৈতিক কাঠামোই ভেঙে পড়বে। সে পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আগেই নীতিনির্ধারকদের সুবুদ্ধির উদয় হোক। সংকট গভীর হলে তখন আইএমএফ বা বিশ্বব্যাংকের কাছে ধরনা দিতে হবে। সে পরিস্থিতির সৃষ্টি হোক, এটি আমরা চাই না।

১ শতাংশেরও কম খেলাপি ঋণ রয়েছে, এশিয়ার এমন দেশগুলোর মধ্যে আছে হংকং, তাইওয়ান ও দক্ষিণ কোরিয়ার নাম। এ তিনটি দেশের খেলাপি ঋণ ২০১৭ সালের তুলনায় ২০১৮ সালে কমেছে। বিদায়ী বছর শেষে তাইওয়ানের খেলাপি ঋণ ছিল শূন্য দশমিক ২ শতাংশ। হংকং ও দক্ষিণ কোরিয়ার খেলাপি ঋণ যথাক্রমে শূন্য দশমিক ৫ ও  শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ। ১ শতাংশের বেশি কিন্তু ২ শতাংশের কম খেলাপি ঋণ রয়েছে এশিয়ার এমন দেশগুলো হলো জাপান, চীন, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও ভিয়েতনাম। উন্নত ও উদীয়মান অর্থনীতির এ চারটি দেশের খেলাপি ঋণের হার নিম্নমুখী। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের তুলনায় চলতি বছরের মার্চ কিংবা এপ্রিল পর্যন্ত এ দেশগুলোর খেলাপি ঋণের হার কমেছে।

চলতি বছরের এপ্রিল শেষে মালয়েশিয়ার খেলাপি ঋণের হার ছিল ১ দশমিক ৫ শতাংশ। মার্চ শেষে খেলাপি ঋণের হার ১ দশমিক ৮ শতাংশ চীনের। ২০১৭ সালে সিঙ্গাপুরের খেলাপি ঋণের হার ১ দশমিক ৪ শতাংশ থাকলেও বিদায়ী বছর শেষে তা ১ দশমিক ৩ শতাংশে নেমে এসেছে। একই সময়ে ভিয়েতনামের খেলাপি ঋণ কমে ১ দশমিক ৯ শতাংশে নেমে এসেছে।

বাংলাদেশের প্রতিবেশী ক্ষুদ্র রাষ্ট্র নেপালের খেলাপি ঋণের হার মার্চ শেষে দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ৭ শতাংশে। চলতি বছরের মার্চ শেষে খেলাপি ঋণের হার ফিলিপাইনে ২ দশমিক ১, ইন্দোনেশিয়া ও কম্বোডিয়ায় ২ দশমিক ৫, থাইল্যান্ডে ৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

এশিয়ার বাইরে ইউরোপ ও আমেরিকার দেশগুলোর খেলাপি ঋণের হারও নিম্নমুখী। ২০১৯ সালের মার্চ শেষে যুক্তরাষ্ট্রের খেলাপি ঋণের হার ১ দশমিক ৬ শতাংশে নেমে এসেছে। অথচ ২০১১ সালে বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির দেশটির খেলাপি ঋণের হার ছিল ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। যুক্তরাজ্যের খেলাপি ঋণের হার শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ। বৃহৎ শক্তিগুলোর অর্থনৈতিক অবরোধ সত্ত্বেও চলতি বছরের এপ্রিল শেষে তুরস্কের খেলাপি ঋণ ৪ দশমিক ১ শতাংশে সীমাবদ্ধ। ২০১৯ সালের মার্চ শেষে দক্ষিণ আফ্রিকার খেলাপি ঋণের হার ৩ দশমিক ৮ শতাংশ। ৩ দশমিক ৭ শতাংশ খেলাপি ঋণ রয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নে।

২০১০ সাল শেষে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৭০৯ কোটি টাকা, যা ওই সময়ে বিতরণকৃত ঋণের ৭ দশমিক ২৭ শতাংশ। একই সময়ে ১৫ হাজার কোটি টাকা ছিল অবলোপনকৃত খেলাপি ঋণ। ২০১৯ সালের মার্চ শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার ৮৭৩ কোটি টাকা। ব্যাংকিং খাতের বিতরণকৃত ঋণের ১১ দশমিক ৮৭ শতাংশই বর্তমানে খেলাপি। এর বাইরে অবলোপনকৃত ঋণ রয়েছে ৪০ হাজার ১০০ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দেড় লাখ কোটি টাকার বেশি।

খেলাপি ঋণ কমানোর ক্ষেত্রে দেশের আইনি কাঠামোর দুর্বলতা ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতাই দায়ী বলে মনে করেন ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী। এজন্য ওই দেশগুলোতে খেলাপি ঋণ কমছে। কিন্তু আমাদের আইনি কাঠামো থেকে শুরু করে খেলাপি ঋণ আদায়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত সব প্রতিষ্ঠানই দুর্বল। এজন্য সদিচ্ছা থাকলেও ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না।

এ ব্যাংকারের ভাষায়, খেলাপি ঋণ কমানোর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের জারীকৃত প্রজ্ঞাপনগুলো সাময়িক ফল দেবে। এতে কিছু সময়ের জন্য খেলাপি ঋণ কমেও আসবে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে ফল পেতে হলে কার্যকর সুশাসন প্রতিষ্ঠাসহ পুরো অবকাঠামোকে ঢেলে সাজাতে হবে।

Comments are closed.

More News Of This Category