লেখক :ইঞ্জিনিয়ার মোঃ জসীম উদ্দিন 

 

বিশ্ববাসী নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে বর্বরতম হামলায় নিহত মানুষের শোকের রেশ কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই শ্রীলঙ্কায় আবারো সন্ত্রাসী হামলা। প্রায় ৪শ’ মানুষ সন্ত্রাসীদের বোমা হামলায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল। ৫ থেকে ৬শ’ মানুষ মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছে। আর অন্যদিকে সন্ত্রাসীরা বুনো উল্লাসে মেতে উঠেছে। বুনো উল্লাস শেষে হয়তো তারা আবারো পৃথিবীর অন্য কোথাও শান্তিপ্রিয় মানুষের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে।
আমাদের দেশেও নাকি এমন সন্ত্রাসী বোমা হামলার চেষ্টা চলছে যা প্রধানমন্ত্রী নিজে বলেছেন। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যথেষ্ট দক্ষ ও সচেতন বলে সুযোগ পাচ্ছে না। সন্ত্রাসী হামলা না হলেও আমাদের দেশে মানবতা বলতে আজ আর কিছু নেই। স্বার্থবাদীতা, অর্থালোভ ও ক্ষমতার মোহে মানবতা আজ নিরুদ্দেশ। কোথায় হারালো মানবতা বলতে পারেন? কুমিল্লার সোহাগী জাহান তনু, সাংবাদিক দম্পত্তি সাগর-রুনি আজও মানবতা খুঁজে বেড়াচ্ছে। সোনাগাজীর নুসরাত ও সর্বশেষ হাজীগঞ্জে দীপিকা পুড়িঁয়ে সেই মানবতার খোঁজে চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেল। তনুর মা আনোয়ারা বেগম এখন আর প্রশাসনের কাছে বিচার চান না, আকাশের পানে আল্লাহর কাছে মেয়ে হত্যার বিচার প্রার্থনা করে। নুসরাতের বিচার শেষবেলায় এসে কোথায় পৌঁছে বলা মুশকিল। মিডিয়ার কল্যাণে শুনেছি পুলিশের ঊর্ধ্বতন কিছু কর্মকর্তাও নাকি সোনাগাজীর অভিযুক্ত সেই ওসি মোয়াজ্জাম খানের পক্ষে সুপারিশ করেছেন।

 

শ্রীলঙ্কায় বোমা হামলায় বাংলাদেশের সংসদ সদস্য শেখ সেলিমের শিশু নাতি জায়ান চৌধুরীও নিহত হয়েছেন। দেশের প্রায় সব মিডিয়াতেই বিষয়টি উঠে এসেছে। দুঃখজনক বিষয় হলো অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোতে প্রকাশিত জায়ানের মৃত্যু সংবাদে অগণিত লোক হা হা হা রিয়েক্ট দেখিয়েছে। বিষয়টি এক দিক থেকে খুবই তুচ্ছ, এগুলো ভাবার হয়তো কারো সময় নেই। কিন্তু মানবিকতার দিক থেকে খুবই লজ্জার। একজন শিশুর নির্মম মৃত্যু সংবাদের যারা অবিবেচকের মতো হাসিতে ফেটে পড়তে পারে তাদের কাছ থেকে জাতি কী আর আশা করতে পারে? শিশুরা নির্দোষ ও নিষ্পাপ- তাদের এমন নির্মম মৃত্যুতেও যারা রাজনীতি টেনে আনেন তাদের ধিক্কার জানানোর ভাষাও জানা নেই। মনে হচ্ছে সব কিছুই আজ নষ্ট রাজনীতির দখলে চলে যাচ্ছে।
মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। সব দিক থেকেই সৃষ্টির সেরা। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো একবিংশ শতাব্দিতে এসে আমাদের চলায় বলায়, আদব কায়দায়, আচার-আচরণ, পোশাকে-আশাকে এমনকি ধর্মে কর্মেও মনুষ্যত্বকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সৃষ্টির সেরা জীবের যেমন বৈশিষ্ট থাকার কথা তা যেনো একেবারেই হারিয়ে বসেছি। কোথাও মানুষের মনুষত্যকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সবাই এক প্রকার সুযোগ সন্ধানী হয়ে উঠেছি। আর কয়েকদিন পরেই মুসলমানদের পবিত্র মাস রমজান শুরু হচ্ছে। অথচ পৃথিবীর অন্যান্য মুসলিম বিশ্বে যেখানে এ মাসে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম পূর্বের চেয়ে কমে যায় আর বাংলাদেশে সেখানে প্রতিটি পণ্যের দাম আগের তুলনায় বহুগুণ বেড়ে যায়। বলা যায় ধর্মের নাম ভাঙিয়েই সব থেকে বেশি ফায়দা হাসিল করছে একদল সুযোগসন্ধানী ধর্ম ব্যবসায়ীরা। ধর্ম প্রচার করতে গিয়ে একশ্রেণীর বক্তারা খোদ নিজেরাই ধর্ম থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন। ইসলামে স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে ধর্ম প্রচারকালে কোনোরূপ আর্থিক লাভ গ্রহণ করা যাবে না অথচ কতিপয় বক্তা হুজুরদের বছরখানেক আগেই টাকা বুকিং দিতে হয় অন্যথায় সিডিউল পাওয়া যায় না। লাখ লাখ টাকা দিয়ে বক্তা আনতে হয়। ফলে ওয়াজ ব্যবসায় কিছু মৌলবী সাহেবরা এতটাই লাভবান হয়েছেন যে কেউ কেউ হেলিকপ্টারে করেও ওয়াজ করতে যান।

মানবতা বর্তমান সময়ে আরো একটি জায়গায় চরমভাবে নিগৃহীত ও লাঞ্ছিত। সেটি হলো যেখানেই দেখবেন সেবার নাম দিয়ে কিছু করা হচ্ছে। হাতে গুণে গুটিকয়েক বাদে, প্রমাণ করার আগেই মোটামুটি নিশ্চিতভাবে ধরে নেবেন এখানেই সাধারণ মানুষের সঙ্গে নতুন করে প্রতারণার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। সহজ-সরল মানুষের সঙ্গে প্রতারণার যতগুলো ধাপ থাকে প্রতিনিয়তই আমাদের দেশের শতকরা ৯৫ ভাগ ডাক্তাররা তা অতিক্রম করে থাকেন। লাশের সঙ্গেও তাদের ব্যবসা বন্ধ থাকে না। কথা প্রসঙ্গে যেহেতু সুযোগ পেয়েছি সেহেতু না বলে পারছি না। চিকিৎসার ক্ষেত্রেও চলছে কী দারুণ ব্যবসা! অথচ সৃষ্টিকর্তার পর আমরা সাধারণ মানুষ ডাক্তাদেরকেই জীবনদাতা ভেবে থাকি। পরিবারের কেউ বড় ধরনের রোগে আক্রান্ত হলে ডাক্তারদের বিশ্বাস করা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। তারা যেভাবে বলে ঠিক সেভাবেই আমাদের সব করতে হয়। আর এ বিশ্বাসের সুযোগেই কোনো কোনো ডাক্তার তাদের আখের গোছাতে থাকে।
আমাদের দেশের মানবতার বর্তমান যে রূপ দাঁড়িয়েছে তা হলো, নানা কারণে ক্ষতিগ্রস্তরা যত অসহায়ই হোক না কেনো ঠিক তাদের কাছ থেকেই ফায়দা হাসিল করে নানা শ্রেণীর লোভী মানুষ নামের অমানুষগুলো। ‘কারো পৌষ মাস কারো সর্বনাশ’ প্রবাদের সঙ্গে বর্তমানে শতভাগ মিল খুঁজে পাই। ঢাকার চক বাজারের কথাই একবার ভেবে দেখুন ! যে রাতে আগুণ ধরলো ঠিক তার পরের দিন সারাক্ষণ পুড়া মানুষ উদ্ধার কাজ চলছে, স্বজনদের কান্নায় আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠছে। সারা শহর ধোঁয়ায় অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে ঠিক সেই দিনও আমাদের আশেপাশের পিকনিক স্পটগুলোতে নাচাগানা আনন্দ ফূর্তি দেদার চলেছে। কাজেই বলা যায় আমরা এখন মানবতার মহাক্রান্তিলগ্নে বাস করছি।

মানবতা হারিয়েছে কারণটা খুঁজলে বলতে হয় আমরা এখন আর কেউ সোনার মানুষ নই। মানুষ যেখানে বাস করে ঠিক সেখানেই মানবতা বাস করে। কাজেই এখন থেকে নতুন করে মানুষ হওয়ার স্বপ্ন দেখতে হবে। পরবর্তী প্রজন্ম যাতে মানুষ হতে পারে সেই ভাবেই তাদের গড়ে তুলতে হবে। অন্যথায় সেদিন আর বেশি দূরে হয়ত নয় যেদিন এ বিশ্বে শুধুমাত্র মানুষের চেহেরায় কিছু প্রাণী বাস করবে, কিন্তু তাদেও মধ্যে মনুষ্যত্বেও কিছু উপস্থিত থাকবে না। দেশে দেশে একের পর এক বোমা হামলাসহ আরো বিধ্বংসী হামলা চলতে থাকবে। আর পরাজয় ঘটবে মানুষের।
লেখক পরিচিতি :
ইঞ্জিনিয়ার মোঃ জসীম উদ্দিন 
লেখক,গবেষক,কলামিষ্ট ।